শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসুন, দুনীির্তকে না বলি

বাংলাদেশে দুনীির্তর সূত্রপাত করেছেন কিছু অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং দুনীির্তর লালনও করছেন তারা। গত দুই সরকারের আমলে মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। জাতীয় এবং স্থানীয় নিবার্চনগুলো এত ব্যয়বহুল হয়ে পাড়েছে যে, এখানে এখন সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের পরিবতের্ কালো টাকার মালিকরাই নিবার্চন করছে। এখন তারা রাজনীতির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। এত টাকা খরচ করার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে নিবাির্চত হয়ে এ টাকাটা উঠিয়ে ফেলা এবং একই সঙ্গে পরবতীর্ নিবার্চনের অথর্ সঞ্চয় করা। বাংলাদেশের দুনর্র্ীতির গ্রাস সবর্ব্যাপী। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুনীির্তর বিকাশ এবং বিস্তার ঘটেনি।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

দুনীির্ত বলতেই আমরা মনে করি, এটি অতি সাধারণ একটা বোধগম্য বিষয়। কিন্তু এ সম্পকের্ তাত্তি¡কদের মতামত বিভিন্ন। প্রত্যেক ধারণার ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞদের নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পরিবেশলব্ধ অভিজ্ঞতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটেছে। দুনীির্তর সবচেয়ে জনপ্রিয় সংজ্ঞাটি দিয়েছে ডড়ৎষফ ইধহশ. ডড়ৎষফ ইধহশ-এর মতে, ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীর স্বাথের্র জন্য (যে গোষ্ঠীর কাছে ব্যক্তি কতর্ব্য হিসেবে কিছু দিতে বাধ্য থাকে) সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারই হচ্ছে দুনীির্ত। দুনীির্তর ধরন/প্রকার সম্পকের্ও বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি স্কুলের মতবাদ অনুযায়ী দুনীির্ত, ৩ প্রকার হতে পারে। যেমনÑ১ম ধরনের আওতায় পেটি, মিডলিং ও গ্রান্ড করাপশন হিসেবে পরিব্যপ্ত, এন্টারপ্রাইজ লেভেল ও রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ পযার্য়ভেদে সংগঠিত হয়ে থাকে। ২য় ধরনের আওতায় ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, আমলা, প্রতিষ্ঠান পযার্য় দুনীির্ত স্বীকৃত মাধ্যম হিসেবে সংগঠিত হয়ে থাকে। ৩য় ধরন হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুনীির্ত। আমরা সাধারণত দুনীির্ত বলতে যা বুঝি সেটাই আমলাতান্ত্রিক দুনীির্ত। এক্ষেত্রে আমলারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেন ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির কারণে। আর রাজনৈতিক দুনীির্ত মূলত আমলাতান্ত্রিক দুনীির্তর বধির্ত রূপ। এর একটি রূপ এরকম হতে পারে-রাজনৈতিক নেতা বা তার আত্মীয় গোষ্ঠী সরকারি অফিস বা কাজ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। যেমন কোনো কাজের কন্ট্রাস্ট থেকে কমিশন নেয়া। দ্বিতীয় রূপটি হলো সরকারি বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়ার জন্য ঘুষ নেয়া। তৃতীয় হচ্ছে শহর এলাকার চাহিদাসম্পন্ন জমি দখল করা। চতুর্থ রূপ চাকরি বা সম্পদে সুবিধাজনক অবস্থান দেয়ার জন্য কাছের লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং পঞ্চম রূপটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব এবং ভোট কিনে নেয়া।

দুনীির্তর প্রভাব অনেক তত্ত¡বিদ ইতিবাচক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু দুনীির্তর ইতিবাচক দিকটি সম্পকের্ যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তা আদতে কতটুকু ইতিবাচক তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ যে প্রক্রিয়াটি প্রশাসনকে ঘুষনিভর্র করে তুলছে। এই নিভর্রশীলতা এমনই যে, দুনর্র্ীতি ছাড়া প্রশাসন আবার স্থবির হয়ে যাবে। তাছাড়া দুনীির্ত প্রশাসনকে সচল করলেও প্রক্রিয়া বা পদক্ষেপ হিসেবে অতি নেতিবাচক। এটি রাষ্ট্র কতৃর্ক সবর্সাধারণের জন্যে কোনো গৃহীত পদক্ষে নয়। বরং ব্যক্তি বিশেষের সুবিধা নেয়ার জন্য ক্ষমতাশালীদের সুবিধা দানের মাধ্যমে প্ররোচনা করা, যা একই পজিশনে চাকরিরত ব্যক্তিদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান আমল থেকেই জনগণের ওপর দুনীির্তর মাত্রা বেড়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দুনীির্ত থেকে মুক্তি এবং সৎ পরিশ্রমী ও বিবেকবান আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোরা। নয়মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন করা একটি দেশের কাছে জনগণের এই দাবি খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবতীর্ বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশের অবস্থা মনে হয়Ñ এ দেশের জনগণের আকাক্সক্ষা অনেকটাই ইউটোপীয়।

স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিপযর্ন্ত বাংলাদেশে অথৈর্নতিক পুনগর্ঠনের জন্য অনেক সাহায্য আসে। এই সাহায্য অধিকাংশই লোপাট হতে শুরু করে। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রেই তারা তাদের ভোগের ভাগ নিশ্চিত করতে গিয়ে নতুন রাষ্ট্রটিকেই দুনীির্তর ওই অতীতের পক্ষে ঠেলে দেয়। যে বাঙালি পাহারাহীন বাংলাদেশে কারও সম্পদ আত্মসাৎ করার কথা ভাবেনি, তারাই এখন রিলিফের মাল চুরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লাল বাহিনীর নামে ট্রেড ইউনিয়ন দখল, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে অফিস-আদালতে সিনিয়রিটি আদায়, বাড়ি দখল এবং বাংলাদেশের যাত্রালগ্নে এক ভয়ালদশর্ন দুনীির্তর জন্ম দেয়। অবস্থাটা এমন ভয়াবহ রূপ নেয় যে স্বয়ং শেখ মুজিবকে এ নিয়ে খেদ করতে দেখা যায়। ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি আর চাটার দল সব চেটে নেয়, আমি সাত কোটি মানুষের জন্য সাত কোটি কম্বল এনেছি, আমার কম্বলটা কই’। তার এসব বিখ্যাত উক্তি সে সময়ে বাংলাদেশের এই দুনীির্তর চেহারাটাই তুলে ধরে। বঙ্গবন্ধু এ জন্য দায়ী করেন একটা নিদির্ষ্ট শ্রেণিকে। তিনি বলেন, আমরা কি ফেরত দিয়েছি বাংলার দুখী মানুষকে, যে দুখী মানুষ না খেয়ে মরে যায়? যে মানুষের কাপড় নেই। বুকের হাড্ডি পযর্ন্ত দেখা যায়। তাকে আমরা আজকে কী দিয়েছি। বাংলার মানুষের মতো ভালো মানুষ কোথাও নেই। বাংলার গরিব ভালো, বাংলার কৃষক ভালো, বাংলার শ্রমিক ভালো। যদি কেউ খারাপ হয় তবে খারাপ আমরা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। তারা বক্তৃতা করেন। তারা কাগজে লেখেন। তারা এখানে এটা করেন ওখানে ওটা করে।

পরবতীর্ সরকার অথার্ৎ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ই মূলত দুনীির্তর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছিল। দুনীির্তর স্বণর্যুগ ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়। দুনর্র্র্ীতি পূবের্ বা পরে আর কখনো এত উচ্চমাত্রা লাভ করেনি। পুরো অথৈর্নতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে করেছিল। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, কোনো দিকেই নীতি ছিল না। সবর্ত্রই দুনীির্ত। একটা বিশেষ গোষ্ঠী এরশাদ সরকারের দুবর্লতার সুযোগ নিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। ব্যবসা, টেন্ডারের সুযোগ সুবিধাও পেয়েছিল এরা।

বাংলাদেশে দুনীির্তর সূত্রপাত করেছেন কিছু অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং দুনীির্তর লালনও করছেন তারা। গত দুই সরকারের আমলে মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। জাতীয় এবং স্থানীয় নিবার্চনগুলো এত ব্যয়বহুল হয়ে পাড়েছে যে, এখানে এখন সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের পরিবতের্ কালো টাকার মালিকরাই নিবার্চন করছে। এখন তারা রাজনীতির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। এত টাকা খরচ করার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে নিবাির্চত হয়ে এ টাকাটা উঠিয়ে ফেলা এবং একই সঙ্গে পরবতীর্ নিবার্চনের অথর্ সঞ্চয় করা। বাংলাদেশের দুনর্র্ীতির গ্রাস সবর্ব্যাপী। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুনীির্তর বিকাশ এবং বিস্তার ঘটেনি। এভাবে গড়ে বছরে দেশে ১০০ মিলিয়ন মাকির্ন ডলারের চেয়ে বেশি মূল্যের শক্তি সম্পদ চুরি হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আছে অন্যান্য চুরি। যেমনÑ চট্টগ্রাম বন্দরে শুল্ক ও কর বিভাগের লোকজনের মাধ্যমে বছরে ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যের সম্পদ চুরি হয়। বছরে গড়ে এ বন্দর থেকে চুরি হয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ। ব্যাংক সেক্টরের উচ্চ দুনীির্তর কারণে মূলধন আমানত এবং সুষ্ঠু ঋণ প্রদান ব্যাহত হয়ে চলেছে মারাত্মকভাবে। ৫০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ সত্যিকারভাবে কাজে লাগছে না দুনীির্তর কারণে। বাংকের ঊধ্বর্তন মহলের অসততাজনিত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের কারণে ৫-১০ শতাংশ ঋণ দেয়া হয় অবৈধভাবে।

পুলিশ বাহিনী সম্পকের্ অভিযোগ আছে তারা ঘুষ নেয়, নিরীহ জনগণকে ধরে অত্যাচার করে, থানায় গেলে মামলা নেয়া হয় না। তাছাড়া সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি এবং মাদক পাচারকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সংযোগ রক্ষা করে চলে। পুলিশের ওপর সাধারণ এবং ভুক্তভোগী মানুষ আস্থাহীন। এ ধরনের একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে দুনীির্তর কারণেই। তবে দুনর্র্ীতির শুরু আজকে নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় দুনীির্তর অস্তিত্ব প্রাচীন কালেই দেখা গেছে। ইংরেজ শাসনের পরেও পাকিস্তান আমলেও পুলিশের এই একই রূপ আমরা দেখেছি। পরিবতর্নটা হয়েছে শুধু বাহ্যিক। হাফপ্যান্ট আর তিনহাত লম্বা লাঠির পরিবতের্ ফুলপ্যান্ট আর কঁাধে সাড়ে সাত সের ওজনের ৩০৩ রাইফেল, বাংলাদেশের পুলিশও এই উত্তরাধিকার বহন করে চলছে।

দুনীির্তর সঙ্গে পুলিশ বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ঘোচাতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। বলা বাহুল্য, জনস্বাথের্ গঠনমূলক সংস্কারের জন্য চাই একটি সচেতন জনগোষ্ঠী। সেই মাত্রা নিরূপণ করে বলা যায়, এদেশে এখন জনগণের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। বাংলাদেশ অধিকাংশ মানুষই সৎ। কেবল উপরি কাঠামোর দুনীির্তর কারণে আজকে আন্তজাির্তক সংস্থার পরিসংখ্যানে তারা সবচেয়ে দুনীির্তগ্রস্ত অংশ হিসেবে চিহ্নিত। এই অবস্থার অবসান চান সবাই। তাই উপযুক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

ভালো আলোকিত পুলিশ ফোসের্র জন্য যে ধরনের ইনভেস্টমেন্ট, যে ধরনের ফিনানসিয়াল সাপোটর্ দরকার সেটা করতে হবে। তাহলে সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান লোককে এখানে আনতে পারবেন। যখন এই ধরনের লোক আসবেন তখন তাদের ব্যবহারে ও দুষ্টিভঙ্গিতে নিশ্চয়ই পরিবতর্ন থাকবে। অনেক প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্যে আমাদের পুলিশ বাহিনীকে কাজ করতে হয়। কেবলমাত্র সুশিক্ষিত সচেতন পুলিশই পারবে ঠাÐা মাথায় এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে। ভালো করতে হলে পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণকে আরও উন্নত করতে হবে। সেটা হলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে।

আসুন দুনীির্তকে না বলি। দুনীির্তর মোকাবিলা করে আমাদের পথ চলাকে সুগম করি। জীবন হোক কুসুমাস্তীণর্। সমাজ হোক দুনীির্ত, জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও অপশাসনমুক্ত। বঙ্গবন্ধুর আদশের্ক লালন করে বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখুন। এ দৃঢ় অঙ্গীকার হোক আমাদের সবার পথ চলার পাথেয়।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: কলামিস্ট ও গবেষক

ভড়ৎয়ধহ.রহভড়@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<20041 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1