শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধমর্ঘট, নৈরাজ্য ও শিশু মৃত্যুর দায়

শুধু ধমর্ঘট ডাকলেও কথা ছিল। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এটাও হয়তো সম্ভব। তবে ধমর্ঘটের নামে যা ঘটেছে তা জঘন্যতম কাজ। কেন সব কিছুর শিকার হবে জনগণ? নাকি অবধারিতভাবে সবকিছুর জন্য জনগণকেই ভোগান্তি পোহাতে হবে।
অলোক আচাযর্
  ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

রোববার অন্যদিনের মতোই সবার শুরু হয়েছিল। রোববার থেকে সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধমর্ঘট ডেকেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। সদ্য পাস হওয়া পরিবহন আইনের প্রতিবাদে এই ধমর্ঘট ডেকেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। ধমর্ঘট, হরতালের সঙ্গে আমাদের দেশের জনগণ বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। এ দেশের অধিকার আদায়ের নামে জনগণের দুভোর্গ ডেকে হরতাল ডেকেছে, ধমর্ঘট ডেকেছে। তবে হরতাল, ধমর্ঘট হলেও এ দেশের মানুষ ঘরে বসে থাকে না। তাদের অফিসে যেতে হয়, স্কুল, কলেজ চলে, বাজার-ঘাট চলে। কারণ পেট তো আর ধমর্ঘট মানে না। তাই বাইরে বের হতেই হয়। হরতালে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, শিক্ষাথীের্দর বহনকারী গাড়ি এরকম অনেক পরিবহন হরতালের আওতামুক্ত থাকে। পাবলিক গাড়ি চলতে না দিলেও এসব জনগুরুত্বপূণর্ যানবাহনে কেউ বাধা দেয় না। এটা মানবিকতা। কারণ আমার মতো যে কারও বিপদ যে কোনো সময় আসতে পারে। রোববার থেকে শুরু হওয়া পরিবহন শ্রমিক ধমর্ঘটে অনেক ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল একটি নবজাতকের মৃত্যু। অভিযোগ রয়েছে মুমূষুর্ অবস্থায় একটি শিশুকে হাসপাতালে নেয়ার পথে পরিবহন শ্রমিকরা দফায় দফায় অ্যাম্বুলেন্সটিকে বাধা দেয়। আর তাতেই শিশুটি মারা যায়। বড়লেখা থেকে সিলেটে নেয়ার পথে শিশুটির মৃত্যু হয়। শিশুটির বয়স মাত্র সাত দিন। এখন পযর্ন্ত শিশুটির কোনো নাম রাখা হয়নি। এই মৃত্যু কি স্বাভাবিক? এই মৃত্যু মেনে নেয়া যায়? কোনো সভ্য মানুষের দল এমনটা করতে পারে? কোন দাবি আদায়ের জন্যই বা কোনো ঘটনার প্রতিবাদে ধমর্ঘট বা হরতাল ডাকা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই দাবি আদায় করতে গিয়ে কেউ বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় মারা যাবে তা কীভাবে সম্ভব? এই মৃত্যু ছাড়াও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ন্যক্কারযোগ্য ঘটনা এদিন ঘটতে দেখেছি। সকাল থেকেই পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় যে পরিবহন বের হয় তাতে কালি লাগাতে থাকে। এমনকি যাত্রীর গায়েও সেই কালি লাগায়। মুখে কালি লাগিয়েছে। এই ধরনের ঘটনা আগে কোনো ধমর্ঘটে ঘটেছে কি? ধমর্ঘটের নামে নোংরামি কি মেনে নেয়া যায়? এর মধ্যে স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রীও বাদ যায়নি। এক কলেজ ছাত্রীর গায়ে কালি দেয়ার ছবি পত্রিকায় দেখেছি।

এটা কোনো সভ্য দেশের সভ্য মানুষ করতে পারে না। সোমবার অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে এসব ঘটনার ছবিসহ ছাপা হয়েছে। ন্যক্কারজনক এসব ঘটনার নিন্দায় সারাদেশ। এত যে কাÐ ঘটে গেল তা কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটেছে তা একবার দেখি। মাত্র কিছুদিন আগে দুই স্কুল শিক্ষাথীর্র সড়ক দুঘর্টনার পর ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামে আন্দোলনে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে সড়ক দুঘর্টনা কমানো যায়। কোথায় আমাদের দুবর্লতা রয়েছে। শিক্ষাথীের্দর এই আন্দোলন তখন সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারা রাস্তায় নেমে লাইসেন্স না পেয়ে আটকে দিয়েছে কমর্কতাের্দর গাড়ি। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল চাইলে সড়ক দুঘর্টনা রোধ করা সম্ভব। তারা ইমাজেির্ন্স লেন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যে দুঘর্টনার প্রেক্ষিতে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সে দুঘর্টনায় একজন চালকের সন্তান ছিল। সেসময় সেই বাসচালক নিজেই এই ঘটনাকে দুঘর্টনা বলেননি। আজ যে শিশু মারা গেল সে যদি কোনো পরিবহন শ্রমিকের সন্তান হতো তাহলে কি হতো। কোন ভালোর জন্য এত দুভোর্গ হয়। ছাত্রদের আন্দোলনে কিছু যৌক্তিক দাবি ছিল। সেই দাবি মেনে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হয়। এই আইনে সাজার মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে কেবল দুঘর্টনা বলে সহজেই পার পাওয়া যেত সেখানে এই আইনে এত সহজে পার পাওয়া যাবে না। আইনটি যুগোপযুগী। সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। সড়ক দুঘর্টনা এবার কিছুটা কমবে এমনটাই আশা ছিল সবার। কারণ অনেক দুঘর্টনায় দেখা গেছে সেটা চালকের ইচ্ছাকৃত ভুল। লাইসেন্সের কথা না হয় বাদই দিলাম। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের লাইসেন্স করাতে ঘোর আপত্তি। ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর মাকার্ গাড়ি রংচং করে যাত্রী টানবে আর দুঘর্টনায় মানুষ মরবে এটাও স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এ সবই এতদিন দুঘর্টনা ছিল। সেটা কেবল দুঘর্টনা বলে পার পেয়ে গেছে এতদিন। পরিবহন শ্রমিকদের দাবি নতুন এ আইন সংশোধন করতে হবে। ড্রাইভার ঘুমঘুম চোখে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেলবে, হেলপার গাড়ি চালিয়ে দুঘর্টনা ঘটাবে, বেশি যাত্রী তুলতে গিয়ে ওভারটেকিং করতে গিয়ে দুঘর্টনায় মানুষ মেরে ফেললে তাকে কেবলই দুঘর্টনা বলতে হবে! এটিকে আর কিছু বলা যাবে না! কারণ গাড়ি নিয়ে বের হলেই দুঘর্টনা ঘটবে। আমরাও মানি।

আইন মেনে গাড়ি চালাতে আমাদের এত আপত্তি কোথায়। নাকি আইন মানাতেই এত অ্যালাজির্ আমাদের। অবশ্য আইন মানাটাই আমাদের দেশে মনে হয় একটা অ্যালাজির্র বিষয়। তাই এখন এই জনগণের এবং এমনকি পরিবহন খাতের মঙ্গলের জন্য করা আইন সংশোধন করতে হবে! না হলে ধমর্ঘট ডাকা হবে। আর ধমর্ঘটে কেউ গাড়ি নিয়ে বের হলেই তার গায়ে পোড়া মবিল ছুড়ে মারতে হবে। রোগীর গাড়িও আটকে দেয়া হবে। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী আবারও মারা যেতে পারে। সাধারণ জনগণের জীবন বিঘিœত করার দুঃসাহস এরা পায় কোথায়? বারবার জনগণকেই জিম্মি করে যার যার অধিকারের নামে এসব হরতাল বা ধমর্ঘট করা হয়। সারাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এবার আসি পরিবহন নিয়ে সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ফিটনেসবিহীন ৬০ লাখ গাড়ি চলছে। এই লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি যদি রাস্তায় কোনো দুঘর্টনা ঘটায় তাহলে তার দায় কেবলই দুঘর্টনার অথবা হতভাগা যাত্রীর কপালের। কোনো পরিবহন শ্রমিক তো এই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো যাবে না এমন কথা বলতে শুনিনি। এই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে আজ আমাদের এই অবস্থা। গত বছর সারাদেশের ৩৩৪৯টি দুঘর্টনায় ১৩ হাজার ৫৫৩ জন হতাহত হয়েছেন। আরও হিসাব আছে। বাসের চাপায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক রাসেল সরকার, গৃহকমীর্ রোজিনা আক্তার, পরিবহন শ্রমিক খালিদ হোসেন, ট্রাফিক পরিদশর্ক দেলোয়ার হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাথীর্ রুনি আক্তার, গৃহবধু আয়েশা খাতুন ও তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনসহ অনেক নাম পরিচয় বের হয়ে আসে যারা বাসের প্রতিযোগিতার শিকার। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে চলতি বছরের প্রথম পঁাচ মাসে সারাদেশে ২ হাজার ৩৩টি সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৪১১ জন। আর এসব ঘটনায় আহত হয় ৬ হাজার ৭৩০ জন। যেখানে চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, বিপজ্জনক ওভারটেকিং এসব দায়ী থাকে। যাত্রীর দায় কতটা থাকে? একজনই ফুটপাত দিয়ে হঁাটতে গিয়ে বাসের নিচে চাপা পড়েছেন। তিনি তো আর জানতেন না বাস সড়ক ছেড়ে ফুটপাত দিয়ে চলতে শুরু করবে। জানলে নিশ্চয় অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে হঁাটতেন। এতকিছুর পরেও যখন জনকল্যাণে সড়ক পরিবহন আইন হয় তখন তা সংশোধনের জন্য ধমর্ঘট ডাকা হয়।

শুধু ধমর্ঘট ডাকলেও কথা ছিল। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এটাও হয়তো সম্ভব। তবে ধমর্ঘটের নামে যা ঘটেছে তা জঘন্যতম কাজ। কেন সব কিছুর শিকার হবে জনগণ? নাকি অবধারিতভাবে সবকিছুর জন্য জনগণকেই ভোগান্তি পোহাতে হবে।

অলোক আচাযর্: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<20042 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1