শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠক মত

উপক‚ল দিবস চাই
নতুনধারা
  ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

উপক‚লের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুযোের্গর সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খেঁাজ রাখা হয় না। উপক‚লের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাচ্ছে না বহুমুখী কারণে। উপক‚লের ভয়াবহতা উপক‚লবাসিরাই কেবল বুঝবে। ১২ নভেম্বরের ঘটনা উপক‚লবাসী আজও ভোলেনি। এটাই উপক‚লবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় দিন। কারণ, ’৭০ সালের এই দিনে উপক‚লের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূণির্ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল গোটা উপক‚ল। প্রাকৃতিক দুযোর্গও এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বেশি বয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী ঘূণির্ঝড় সিডর, আইলাসহ নানা দুযোের্গর আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে বেড়িবঁাধ। তার পরে নাগির্স, রেশমা, গিরি, রোয়ানুতো রয়েছেই। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ঘূণির্ঝড় সিডর এই জনপদের বিশাল বেড়িবঁাধের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয় ৩৬৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বঁাধের। অল্প ক্ষতি হয় ২ হাজার ১৪ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে উপক‚লে আবারও আঘাত হানে ঘূণির্ঝড় আইলা। বড় ধরনের দুটি ঘূণির্ঝড়ের এসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বঁাধ দ্রæত মেরামত না হওয়ায় বিস্তীণর্ এলাকা এখন প্লাবিত হয়ে আরও ভেতরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী ঘূণির্ঝড় ১৯৮৮ সালে সংঘঠিত হয়। এই ঘূণির্ঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সবর্নাশা বন্যা হিসেবে পরিচিত। ২১ নভেম্বর মালাক্কা প্রণালিতে এই ক্রান্তীয় ঘূণির্ঝড়ের উৎপত্তি হয়েছিল। শুরুতে এটি পশ্চিমগামী ছিল, এরপর গভীর নিম্নচাপ থেকে ক্রমান্বয়ে আন্দামান সাগরে এসে ঘূণির্ঝড়ে পরিণত হয়। নভেম্বর ২৬ তারিখে, এটি তীব্র ঘূণির্ঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তরদিকে ঘুরে যায়। ধীরে ধীরে এর গতি তীব্রতর হয়ে ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের স্থলভ‚মিতে আঘাত করে। এই গতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী অবস্থা ধরে রাখে এবং এটি ৩০ নভেম্বর পযর্ন্ত বাংলাদেশের মধ্যবতীর্ অঞ্চলে মাঝারি ঘূণির্ঝড় হিসেবে সক্রিয় ছিল। ঘূণির্ঝড়ের কারণে সবের্মাট ৬,২৪০ জনের মৃত্যু ঘটে, এরমধ্যে বাংলাদেশের ৫,৭০৮ জন এবং পশ্চিমবঙ্গের ৫৩৮ জন। অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে প্রচÐ ঝড়ের কারণে, বাড়ি ভেঙে পড়ে এবং আক্রান্ত অঞ্চলের বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে তড়িতাহত হয়। ১৯৯১ সালের ঘূণির্ঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূণির্ঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে দক্ষিণপূবর্ চট্টগ্রাম বিভাগের উপক‚লীয় অঞ্চলে ঘণ্টা বেগে প্রায় ২৫০কিমি আঘাত করে। এই ঘূণির্ঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ¡াস উপক‚লীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সবর্স্ব হারায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদীর কাছে উপক‚ল অতিক্রম করে। সে সময় বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন না থাকলে পাথরঘাটাসহ উপক‚লের কোনো চিহ্ন থাকত না। প্রায় ৯৬৮,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং ২১০,০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল, প্রায় ২৪২,০০০ গৃহপালিত পশু এবং হঁাস-মুরগি মারা গেছে। এ কারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী একে ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূণির্ঝড় আখ্যা দেয়া হয়েছিল। ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যা পযর্ন্ত সরকারিভাবে ২ হাজার ২১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল সরকার। এ ছাড়া আইলা, নাগির্স, রোয়ানুসহ ছোট ছোট নানা দুযোর্গসহ প্রতিনিয়ত উপক‚লের বাসিন্দারা দুযোর্গ মোকাবেলা করছে। বিগত বছরে যতগুলো ঘূণির্ঝড় হয়েছে বেশির ভাগই নভেম্বর মাসে। এত কিছুর পরেও উপক‚লকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। আগেই বলেছি ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, দিবস থেকে মানুষ অভিজ্ঞতা অজর্ন করে এবং দিবসের ইতিকথা স্মরণে রাখে। ঠিক তেমনি মনে রাখার মতো একটি দিন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। উপক‚লে যে ভয়াবহতা হয়েছে তা মনে এ প্রজন্মের মানুষ জানে না। হয়তো এই দিনে দিবস হিসেবে পালন করলে হয়তো এ প্রজন্মের মানুষ মনে রাখত। তাই আমরাও চাই একটি দিবস। যার নাম হবে ‘উপক‚ল দিবস’। হয়তো প্রশ্ন জাগবে, এত দিবসের ভিড়ে কেন আবার ‘উপক‚ল দিবসের’ দাবি? আমার প্রশ্নটা ঠিক এর বিপরীত। এত দিবস থাকা সত্তে¡ও ‘উপক‚ল দিবস’ নেই কেন? উপক‚ল অঞ্চলে আমার জন্ম, উপক‚ল নিয়েই ভাবি। খবর লেখার মধ্যদিয়ে আমি প্রতিদিন উপক‚লের কথা মনে পড়ে মনে পড়ে উপক‚লের ভয়াবহতা। কিন্তু একটি দিবস থাকলে অন্তত সবাই মিলে একযোগে উপক‚লের কথা বলার সুযোগ পাই! দিন ঠিক করার আগে নিজের কাছে নিজের আরেকটা প্রশ্নÑ কেন উপক‚ল দিবস চাই? দিবসগুলো দ্বারা বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশের স্বকীয় ও বিশ্বব্যাপী পালিত দিবসগুলোকে। এই সব দিবসের তালিকা নিম্নে প্রণীত হলো। দিবসগুলোর অধিকাংশই প্রায় নিয়মিত পালিত হয় এবং হয়ে আসছে। কিন্তু কিছু কিছু দিবস, বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে, প্রতিহিংসাবশত, ওই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা চলাকালীন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় না। আন্তজাির্তক ও বৈশ্বিক দিবসগুলোর জন্য সরকারি ও আন্তজাির্তকভাবে অথর্ বরাদ্দ পাওয়ার প্রেক্ষিতে তা পালিত হয়। তবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বহুল প্রচলিত কিছু কিছু দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় না সাম্প্রদায়িক কারণবশত। যেমন: ইহুদিদের বিভিন্ন ধমীর্য় অনুষ্ঠানাদি বাংলাদেশে পালিত হয়না কেননা বাংলাদেশে ইহুদি ধমার্বলম্বীরা বাস করেন না। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক পাথের্ক্যর কারণে অন্যান্য অনেক দেশের বা জাতির স্বকীয় ঐতিহ্যমÐিত দিবসও বাংলাদেশে পালিত হয় না। সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের বিভিন্ন ধমীর্য় দিবস মূল ধারার সংস্কৃতি হিসেবে পালিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে উপক‚ল দিবসের দাবি তুলছেন উপক‚ল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল জানাির্লস্ট ফোরাম, কোস্টাল ইয়ুথ নেটওয়াকর্-আলোকযাত্রা, নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, নিঝর্র এন্টারপ্রাইজ, প্রিন্ট মিডিয়া পাটর্নার দৈনিক খোলা কাগজ, অনলাইন মিডিয়া পাটর্নার বিডিমিরর একাত্তর ডটকম, উপক‚লীয় উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আস্থা’, পাথরঘাটা উপজেলা নাগরিক অধিকার ফোরামসহ ১০০টি সংগঠনের সমন¦য়ে ‘উপক‚ল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’। উপক‚লে ’৭০-এর ঘূণির্ঝড়, ২০১৫ সালের সিডর, সিডর পরবতীর্ আইলা, হারিকেন, নাগির্স, রোয়ানু, মোরাসহ বিভিন্ন দুযোের্গর আঘাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু ঘূণির্ঝড় এলেই প্রচার মাধ্যমের ক্যামেরাটা উপক‚লের দিকে ছুটে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে উপক‚লে জীবন-যাপন কতটা যে অস্বাভাবিক তা গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে আসে না। এজন্য বিভিন্ন ঘূণির্ঝড়ে নিহতদের স্মরণ, দুযোর্গ মোকাবেলায় মানুষকে সচেতন, উপক‚লের সমস্যা আর সম্ভাবনাকে প্রকাশের আলোয় আনার জন্য ১২ নভেম্বরকে ‘উপক‚ল দিবস’ পালন করা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দিবসটি যখন পালন হবে, তখন সরকারের নীতি-নিধার্রণী পযাের্য় উপক‚ল ফোকাস হবে এবং উপক‚ল সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। আর দিবসটি শুধু উপক‚লে বসাবসরত ৫ কোটি মানুষের উন্নয়নের স্বাথের্। ইতোমধ্যে দিবসের জন্য ‘উপক‚ল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির’ যে আন্দোলন আন্তজাির্তক, জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে এবং সামাজিকভাবে যে জনমত তৈরি হয়েছে, তা ইতিহাসে ব্যতিক্রম। পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির মধ্য দিয়েই সেটা স্পষ্ট। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। তাই ৭১০ কিলোমিটার দীঘর্ উপক‚লীয় এলাকার জীবন-জীবিকা মানুষরা দেশের উন্নয়নের অগ্রণী ভ‚মিকা রাখছে। গণতন্ত্র, অথর্নীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উপক‚লীয় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের ভ‚মিকা কম নয়। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা দিলে পরিপূণর্ভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সে কারণে উপক‚লের জন্য সরকারের এগিয়ে আসতে হবে, এনজিওসহ গণমাধ্যমেরও এগিয়ে আসা উচিত। আসুন আমরা সবাই উপক‚লের জন্য একটি দিন একটি দিবস চাই যার নাম হবে ‘উপক‚ল দিবস’।

শফিকুল ইসলাম

পাথরঘাটা, বরগুনা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22317 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1