শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধষর্ণ কি থামবে না?

মো.ওসমান গনি ঢাকা
  ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

দেশে একের পর এক খুন ও ধষর্ণ বেড়েই চলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মানুষরূপী কিছু নরপিশাচ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে রূপাকে দলবদ্ধ ধষর্ণ করে পরে তাকে হত্যা করে। সেই ধষর্ণ ও হত্যা মামলার রায়ের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটল আবার একই ঘটনা। বাসে ধষর্ণ করাটা যেন এখন একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। যা এখন এক নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এখন ঘটছে আমাদের দেশে।

ধষের্ণর মতো রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যেন দিন দিন বাড়ছে। রাস্তায় যানবাহন যে নারীদের জন্য চরম অনিরাপদ এ কথায় যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এসব ঘটনা। সময়ের সঙ্গে সভ্যতার পরিবতর্ন হলেও পরিবতর্ন হয়নি মানুষের মানসিকতার, কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অনেক বেড়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ধষের্ণর ক্ষেত্রে নিত্যনতুন বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নোয়াখালীর সুবণর্চরের ধষির্তা মহিলার করুন বিলাপ ‘তোদের পায়ে পড়ি, আমাকে বেইজ্জতি করিস না, পোলাপাইন আমাকে মা বলে ডাকবে না’। রাজনৈতিক ও নিবার্চনী প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে নোয়াখালীর সুবণর্চরে ৪ সন্তানের এক জননীর গণধষের্ণর এ মমাির্ন্তক ঘটনা দিয়েই শুরু হয় নতুন বছর। এর পর একের পর এক আলোচনায় আসে ধষর্ণ ও হত্যা। গত ৬ জানুয়ারি (রোববার) রাজধানীর পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ২ বছরের শিশুর ওপর পাশবিকতা ও হত্যার অভিযোগে থানা ঘেরাও। সবোর্পরি ডেমরায় ২ শিশুর লাশ উদ্ধার। মাঝে সাতক্ষীরায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধষর্ণ শেষে হত্যা, বগুড়ায় ৬ বছরের শিশু ধষর্ণ, সাভারের আশুলিয়ায় গণধষের্ণ কিশোরীর মৃত্যু, মৌলভীবাজার ও মাগুরায় শিশু ধষর্ণ এবং নারায়ণগঞ্জে কবিরাজের হাতে পঞ্চম শ্রেণির শিশুছাত্রীর শ্লীলতাহানি। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় আসে ধষের্ণর ঘটনা। ধিক্কার ও নিন্দার ঝড় ওঠে সারা দেশে। নোয়াখালীতে ৪ সন্তানের গণধষের্ণর ঘটনার আসামিকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদশের্র বানানোর চেষ্টা, সাভারের আশুলিয়ায় গণধষের্ণর ঘটনায় থানায় মামলা না নেয়া এবং ভুক্তভোগীর মৃত্যুর ঘটনা সবাির্ধক সমালোচিত। এসব ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে সুশীলসমাজসহ সব বিবেকবান মানুষ। নতুন বছরের সপ্তাহ পার না হতেই দেশজুড়ে এ ধরনের পাশবিকতা-ধষর্ণ ও খুনের ঘটনায় শঙ্কা ও উৎকণ্ঠায় সব শিশুর অভিভাবকমহল। তারা চান ধষর্কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এসব ধষের্কর পক্ষে কোনো আইনজীবীকে আইনি সহায়তা না দিতেও তারা আহŸান জানান। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু ধষের্ণর পেছনে মানুষের মূল্যবোধ-নৈতিকতার অবক্ষয়, পনোর্গ্রাফি ও মাদকের প্রভাব অন্যতম। এ ছাড়া ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সহজে সবাই পনোর্গ্রাফি দেখতে পাচ্ছেন। ফলে জৈবিক ও মানসিক বিকারগ্রস্তিতা থেকে অনেকে শিশুদের ধষর্ণ করছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, অপরাধের বিচারে দীঘর্সূত্রতার কারণে এ ধরনের ঘটনায় সাহস পাচ্ছে অপরাধীরা। ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীর সুবণর্চরে ভোটের রাতে গণধষের্ণর শিকার হন ৪ সন্তানের এক জননী। ঘটনার আগে ওই নারীর স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রাখে ধষর্করা। যার নেতৃত্বে এ ববর্র এ ঘটনা ঘটে, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। বলা হয় ধষের্ণর নেতৃত্ব দেয়া অভিযুক্ত ব্যক্তি আগে বিএনপি করতেন। বক্তব্যের পর ঘটনাটি নতুন করে আবার আলোচনায় আসে। সব মহল থেকে দাবি ওঠে ধষের্কর পরিচয় ধষর্ক। তাকে ধষর্ক হিসেবেই বিচার করতে হবে। রাজধানীর পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের ৫৩/১/ছ নম্বর চারতলা বাড়ির পাশে টিনশেড বস্তিতে মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে থাকত ২ বছরের শিশু আয়েশা। গত ৫ জানুয়ারি (শনিবার) তার মা অন্যের বাড়িতে কাজে যায়। খেলতে বের হয় আয়েশা। সন্ধ্যায় তার রক্তাক্ত লাশ মেলে পাশের চারতলা বাড়ির সামনে। অভিযোগ রয়েছে, পাশের চারতলা বাড়ির চতুথর্ তলার ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া বাসিন্দা নাহিদ (৪৫) শিশুটিকে খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে বাসায় ডেকে নিয়ে ধষর্ণ করেছে। ঘটনা ফঁাস হওয়ার আশঙ্কায় চারতলা ভবনের তিনতলা থেকে তাকে নিচে ফেলে হত্যা করেছে। প্রতিবাদে এলাকাবাসী সোমবার দুপুরে গেন্ডারিয়া থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে। সোমবার রাজধানীর ডেমরায় একটি ফ্ল্যাট থেকে দুই শিশু নুসরাত জাহান (৪) ও ফারিয়া আক্তার দোলার (৫) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় মোস্তফা নামের এক ব্যক্তি ঘটনার দিন দুপুরে খেলারত শিশু দুটিকে ডেকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে ধষের্ণর পর শিশু দুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সাভারে একটি পোশাক কারখানার তিন কমর্কতার্ ও কথিত প্রেমিকসহ ৫ জন মিলে ধষর্ণ করে গামের্ন্ট শ্রমিক কিশোরী নাজমাকে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন কিশোরী ও তার বাবা। পুলিশ তা আমলে নেয়নি। বলেছিল ধষের্ণর ঘটনার প্রত্যক্ষদশীর্ নিয়ে যেতে। তবে একদিন পর মারা যাওয়ার পর নাজমার লাশ উদ্ধারসহ ধষর্ণ ও হত্যামামলা নেয় পুলিশ। ক্ষোভের সঙ্গে নাজমার বাবা হানিফ আলী বলেন, পুলিশ অভিযোগ আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে আমার মেয়ে প্রাণে বেঁচে যেত। ২ জানুয়ারি সকালে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা রেল কলোনিতে ছয় বছরের শিশুকে ধষর্ণ চেষ্টার সময় লতিফ প্রামাণিক নামে লম্পটকে হাতেনাতে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। শিশুটিকে কৌশলে একটি বাড়িতে নিয়ে ধষর্ণ করে ফেলে যায় লম্পট। ভোটের দিন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চতুথর্ শ্রেণির এক শিশু শিক্ষাথীের্ক ধষর্ণ করে রুশন মিয়া নামে এক লম্পট। শিশুটিকে আদমপুর ইউনিয়নের কামারছড়া রাবার বাগানে নিয়ে যাওয়া হয় কৌশলে। স্থানীয়রা শিশুটিকে বাগান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভতির্ করে। গত ৮ জানুয়ারি কুমিল্লার বুড়িচংয়ে ৫ বছরের এক শিশুকে ধষের্ণর চেষ্টা চালায় কাজী ইউনুস (৫৫) নামে এক লম্পট।

শিশুটিকে রুটি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে পাশ্বর্বতীর্ একটি পরিত্যক্ত জমিতে নিয়ে ধষের্ণর চেষ্টা চালায়। শিশুটি চিৎকার করলে লম্পট ইউনুস পালিয়ে যায়। গত সোমবার মাগুরার শালিখায় ৩ বছরের শিশু ধষের্ণর শিকার হয়। শিশুটি বাড়ির পাশে খেলা করার সময় প্রতিবেশী সাকিব মোল্লা খড়ের গাদায় নিয়ে ধষর্ণ করেন। এ সময় শিশুটির চিৎকারে সাকিব পালিয়ে যায়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভতির্ করা হয়। বেড়ানোর কথা বলে ৩১ ডিসেম্বর বিকালে কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি ইটভাটায় আটকে রেখে ৫ম শ্রেণির এক শিশুছাত্রীকে ধষর্ণ করে নূর গাজী নামে এক কবিরাজ। অন্য একটি মমাির্ন্তক ঘটনা ঘটেছে ৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায়।

টিউশনি করতে প্রতিবেশী বড় বোনের কাছে গিয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী। শিক্ষিকা বাসায় না থাকায় তার ভাই জয়দেব সরকার শিশুটিকে খাবার কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে ধষর্ণ করে। পরে শিশুটিকে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেয়। শিশুটিকে না পেয়ে যখন ওই পুকুরে জাল ফেলার কথা হয়, ঠিক তখন শিশুর লাশটি তুলে আনা হয় পানি থেকে। এরপর লাশটি বাথরুমে ¯øাবে ঢুকিয়ে রাখে। পরে সেখান থেকে লাশটি উদ্ধার করে প্রতিবেশীরা। যদিও এসব ঘটনায় অভিযুক্ত আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। চলছে আইনি প্রক্রিয়া। তবে একের পর এক ধষের্ণর ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাই বেশি ধষের্ণর শিকার হন। পক্ষান্তরে ধষর্ক পক্ষ থাকে অথৈর্নতিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবশালী। বিকৃত যৌনাকাক্সক্ষা, যৌনাচার ও বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও অধিকাংশ গণধষের্ণর পেছনে অপরাধীদের শক্তি জোগায় তার রাজনৈতিক পরিচিতি অথবা আথির্ক শক্তি। যে কারণে কখনো পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও স্বাথের্র দ্ব›েদ্বর বলি হচ্ছে শিশু থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সী নারী। বিচার বিলম্বতার কারণে কিংবা অনেক মামলা আপস হয়ে যায়। নারী ও শিশু নিযার্তনের কঠোর আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। অনেকে ঝামেলা এড়াতে কিংবা অজ্ঞতার কারণে আদালত বা পুলিশের দারস্থও হন না। যে কারণে এসব অপরাধ অহরহই ঘটছে। আমরা জানি, লুটেরাপুঁজির দৌরাত্ম্য শেষ না হওয়া পযর্ন্ত এ ধরনের পাশবিক কমর্যজ্ঞের পরিসমাপ্তি ঘটানো সম্ভব নয়। আর এই দৌরাত্ম্যকে রাতারাতি সরিয়ে দেয়াও যাবে না। সে কারণে এর লাগাম টেনে ধরার জন্য আমরা এ ধরনের অপরাধকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সবোর্চ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের পথকে উন্মুক্ত করার জোর দাবি উত্থাপন করছি। সমাজে এ ধরনের পৈশাচিক ববর্রতা ক্রমেই বাড়তে থাকলে, একসময় তা মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই শুরুতেই এর কবর রচনা করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্র এবং সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। আর দেশের বিবেকবান মানুষ এ কাজে সব সময় রাষ্ট্র ও সরকারের পাশে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31819 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1