শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে আন্তজাির্তক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশ্যই এই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের দ্বারা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা অবশ্য তেমনটা হোক তা চাই না।
মো. মাঈন উদ্দিন
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

একটি ছোট্ট গল্প দিয়েই শুরু করি। ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। আমি তখন অনেক ছোট তবে ঘটনাটা স্পষ্ট মনে পড়ছে। তখন মানুষের একজিমা যা বিখাউজ নামে প্রচলিত, এই বিখাউজ হলে ধুতরার ফুল রান্না করে খাওয়াত। মানুষের বিশ^াস ছিল ধুতরার ফুল রান্না করে খেলে বিখাউজ ভালো হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এই ধুতরার ফুল খেলে মানুষের সাময়িক মস্তিস্কহানী দেখা দিত। এতে মানুষ পাগলামী শুরু করে দিত। তো আমার চাচাতো ভাইয়ের ঘরের সবাই তখন বিখাউজ রোগে ভুগছিল। আমার চাচাতো ভাই ধুতরার ফুল রান্না করে সন্ধ্যারাতে স্ত্রী-সন্তানদের খাওয়ালেন। এর আধ-ঘণ্টা পরে শুরু হয়ে গেল মাতলামি। একেকজন উল্টা-পাল্টা কথা বলে আর চাচাতো ভাই তা দেখে হাসে। আনন্দে তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে বলে- দেখ, সবাই কেমন পাগলামি করছে। আস্তে আস্তে পাগলামির পরিমাণ বাড়তে লাগল। একপযাের্য় দেখা গেল পাগলামি করতে করতে একেক জন একেকদিকে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। চাচাতো ভাই একা আর কুলিয়ে উঠতে পারল না। শেষে তার মেমাজ বিগড়ে গেল। তিনি লাঠি হাতে নিয়ে সবাইকে মারতে উদ্যত হলেন। অথার্ৎ শুরুর দিকের সাময়িক আনন্দ অবশেষে বিষাদে পরিণত হলো। আমাদের হয়েছে ঠিক একই ঘটনা। রোহিঙ্গা মুসলিমরা যখন রাখাইন থেকে আসতে লাগল। আমরা অনেকেই সহানুভ‚তিশীল হয়ে পড়লাম (অবশ্য সহানুভ‚তিশীল না হয়ে উপায় ছিল না)। অনেকে ধারণা করেছিলাম, হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যা ততটা গভীর হবে না। অনেকে মনে করেছিলাম, আন্তজাির্তক চাপে পড়ে মিয়ানমান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেই। অনেকেই মনে করেছিলাম, এমন হৃদয় বিদারক ঘটনায় সারা বিশ^ বাংলাদেশকে সমথর্ন দেবে। কিন্তু বাস্তবে এর ছিটেফেঁাটাও হয়নি। পাল্টা চীন ও রাশিয়া (স্বাথের্র খাতিরে যুগল বন্ধু) মিয়ানমারের দিকে হেলে গেল। তারা দ্বৈতনীতি গ্রহণ করল। কাজের কাজ কিছুই হলো না। দশ লক্ষ রোহিঙ্গা আজও রয়ে গেল সতের কোটি মানুষের ছোট্ট এই দেশে। যে দেশের রাস্তায় চলতে গেলে মানুষের কঁাধে কঁাধ লেগে যায়। আমাদের সরকারের শত আন্তরিক প্রচেষ্টা ব্যথর্ হলো। উল্টো বতর্মানে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার যে পরিস্থিতি সৃৃষ্টি করছে তাতে রোহিঙ্গাদের ফেরার রুদ্ধ হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের সঙ্গে আমাদের বতর্মান সম্পকর্ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। তবুও ভারতের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী পদক্ষেপ পাচ্ছি না। এহেন পরিস্থিতিতে বতর্মান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই ভারতের শরণাপন্ন হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানের জন্য ভারতের কাছে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। তিন দিনের ভারত সফর শেষে শনিবার বিকালে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সহায়তা চেয়েছি। আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরে যাক। এজন্য রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে নতুন একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সহায়তা চেয়েছি। আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরে যাক। ভারতের কাছে দেয়া নতুন প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেফ হেভেন বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনবার্সনের ব্যবস্থা করা হোক। ওই এলাকায় রোহিঙ্গারা নিভের্য়, নিরাপদে, টেকসই জীবন নিবার্হ করতে পারছেন কিনা, তা দেখভালের দায়িত্ব নিক মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।

তিনি বলেন, সেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত, চীন ও আশিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলো থাকবে। ভারত যেন এ সমাধান সূত্র নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে। ভারত এ প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি জানান, ভারত এ প্রস্তাব নিয়ে কাজ করবে। শুক্রবার বাংলাদেশ হাইকমিশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সম্মানে দেয়া নৈশভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাবের বিষয়টি অবহিত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রস্তাবটি তুলে ধরেন আব্দুল মোমেন।

প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, আমি সুষমা স্বরাজকে বিস্তারিত সব বলি। উনি জানতে চান, কথাটা আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলেছি কিনা। উত্তরে আমি জানাই, বলেছি, তবে সংক্ষিপ্তভাবে। শুনে মোদি ইনোভেটিভ প্রপোজাল বলে মন্তব্য করেছেন। সুষমা তখন বলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো আপনার বন্ধু। প্রস্তাবটা তাকে দিচ্ছেন না কেন? জবাবে বলি, বন্ধু ঠিকই; কিন্তু প্রস্তাবটা ভারতের কাছ থেকে গেলে মিয়ানমার বেশি গুরুত্ব দেবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন আরও বলেন, ২৪ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, ১৮ হাজার নারী ধষের্ণর শিকার হয়েছেন, সোয়া লাখ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ১ লাখ ২০ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, ৮ লাখ মানুষ বাংলাদেশে চলে এসেছেন। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর বড় বড় নেতাদের বঁাচিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ধনী রাষ্ট্র নয়। দেশটা ঘনবসতিপূণর্ও। এ বাস্তুচ্যুতদের ফিরে যেতে হবে। না হলে সৃষ্টি হবে অরাজকতা অনিশ্চয়তা। মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে।

তিনি বলেন, সুষমা স্বরাজকে বলেছি, প্রত্যাবতর্ন ও পুনবার্সনের কাজ সম্পন্ন না হলে এ অঞ্চল সবার জন্য নিরাপদ থাকবে না। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা না থাকলে অথৈর্নতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো দরকার।

দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পযাের্য়র যৌথ পরামশর্ক কমিশনÑ জেসিসি বৈঠকে যোগ দিতে বুধবার ঢাকা ত্যাগ করেন ড. মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ড. এ কে আবদুল মোমেনের এটাই প্রথম বিদেশ সফর। তিন দিনের এ সফরে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সংসদীয় পরামশর্ক কমিশনের (জেসিসি) পঞ্চম বৈঠকে যোগ দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও তিনি দেখা করেন।

এখন কোটি বিলিয়নের প্রশ্ন হলো, ভারত সরকার এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত নিতে কতটা আন্তরিক হয়ে কাজ করবে? ভারত কাজ করলে ভালো। কিন্তু ভারত যদি তাদের স্বাথর্ হাসিলের জন্য রোহিঙ্গা ফেরতে কাজ না করে কিংবা তাদের প্রচেষ্টা যদি ব্যথর্ হয়, তাহলে বাংলাদেশকে আন্তজাির্তক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশ্যই এই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের দ্বারা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা অবশ্য তেমনটা হোক তা চাই না।

মো. মাঈন উদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36252 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1