শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বনানী ট্র্যাজেডি: আমাদের দায়

আমরা নিমতলীর ঘটনা দেখেছি, আবার চুড়িহাট্টা দেখলাম, দেখলাম বনানী ট্র্যাজেডি কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো কী করেছে বা করতে পেরেছে? আমরা শুধু ক্ষত স্থানে সাময়িক মলম লাগাতে পেরেছি, ক্ষত সারাতে পারিনি।
মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ
  ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অগ্নিকান্ডে ক্ষতি বর্ণনাহীন। যা পূর্ব থেকে ধারণা করা যায় না আবার আগুন লাগার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে কিছু করারও সুযোগ থাকে না। নিজে বাঁচার বা সবার সঙ্গে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাই তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিয়তিই জানে কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না। এটাই বাস্তবতা।

বনানীর অগ্নিকান্ড দিনের বেলায় হওয়াতে সাধারণ মানুষ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। তা ছাড়া আশপাশের কর্মজীবী মানুষ, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এমনকি যে মানুষটি দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে অবস্থান করছিল সেও তার অবস্থান প্রিয়জনকে জানাতে পেরেছিল। আমরা জানি না তাদের কতজন বাঁচতে পেরেছিল আর কতজনই বা মারা গেছেন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার অগ্নিকান্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য কতজন ইন্টারনেটের তার ধরে নামতে গিয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। বিল্ডিংয়ে অবস্থানরত অনেকে আবার সঙ্গে থেকে সঙ্গ দিয়েছেন যাতে তারা নিরাপদে নামতে পারেন। যদিও নিচ থেকে সবাই তাদের নামতে নিষেধ করছিলেন। কে চায় বলুন এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে যেতে, বাঁচার যে আকুতি সার্বজনীন তা এই বনানী ট্র্যাজেডির খুব কাছ থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি।

আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কতজন আবেদন জানিয়েছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। কতজন যে ভয়ে ও শ্বাসকষ্টে মৃতু্যবরণ করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। কেউ আবার গায়ে ব্যাগ জড়িয়েও মারা গেছেন। কি ভয়াবহ দৃশ্য ভাবা যায়?

আমাদের দেশে বর্তমানে একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই মিডিয়া আজকাল দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সরাসরি সম্প্রচার করে আমাদের উদ্ধার কাজে এগিয়ে যেতে জানিয়ে দেয়, এটা আমাদের বড় প্রাপ্তি। সে সূত্রে উদ্ধার কাজে কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা তাও প্রত্যক্ষ করা যায়। ইচ্ছা করলে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণও করা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, জনগণের অধিক অংশগ্রহণ ও অশৃঙ্খলিত অবস্থানের কারণে উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্নও ঘটে।

দুর্ঘটনার প্রায় ঘণ্টাখানিকেরও বেশি সময় নিয়ে দমকল বাহিনী তাদের কার্যক্রম চালু করতে পেরেছিল, এটা যেমন সত্য, তেমনি দমকল বাহিনীর কিছু অকুতোভয় সৈনিক সব সময় যে নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করেন তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। একজন উদ্ধার কর্মী নিজের পা ভেঙেও উদ্ধার কাজকে ত্বরান্বিত করেছেন। সত্যি এটি একটি বড় মহত্ত্ব।

পুলিশবাহিনী, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী সবাইকে সমান দক্ষতায় কাজ করতে দেখেছি। দেশের দুর্যোগে সবাই একতাবদ্ধ হয়েছেন এটাই বড় প্রাপ্তি।

তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের সব সক্ষমতা থাকতেও কেন আমাদের এতগুলো জীবন মৃত বলে ঘোষণা করতে হয়েছে। অনেকেই শুনেছি এফ আর টাওয়ারের ছাদ থেকে অন্য বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছেন এবং একটা সময় পরে কোনো অতি উৎসাহীগোষ্ঠী ছাদে তালা লাগালে আর কেহ এফ আর টাওয়ার থেকে বের হতে পারেননি। কারা তালা লাগালো তা জনগণকে জানাতে হবে। ছাদে তালা থাকায় কতজনের প্রাণ যে আগুন কেঁড়ে নিয়েছে তা আলস্নাহ্‌পাকই ভালো জানেন।

যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন সরকারি মন্ত্রী, আমলা ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের বেশ তৎপরতা দেখা যায়। তাদের উপস্থিতি এবং কথাবার্তায় মনে হয় এই ধরনের দুর্ঘটনা এটাই প্রথম এবং এর সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র। আসলে এই ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা যে কত ঘটেছে তা হিসাবের বাইরে। আমরা কেবল বড় বড় ঘটনাগুলো যা শহরের ভেতরে ঘটে তা জানি এর বাইরে কত দুর্ঘটনা ঘটছে তা আমরা জানতেও পারি না, যদি তা মিডিয়া প্রকাশ না করে।

ঘটনা ঘটলে সব বিভাগই পারলে তদন্ত করার আশ্বাস দেয়, এটা তার বিভাগের অন্তর্ভুক্ত কিনা তা বিবেচনার বিষয় নয়। ২৮ মার্চ ২০১৯ বনানী ট্র্যাজিডির মতো আরো অনেক ট্র্যাজিডি দেখেছি যেমন রানাপস্নাজা, তাজরিন ফ্যাশন যার কারণে আমাদের গার্মেন্টস্‌ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছিল। তখন অনেকে কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমরা কি সে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পেরেছি। তাই কথা নয়, কাজের মানুষ দরকার খুব বেশি।

আমরা নিমতলীর ঘটনা দেখেছি, আবার চুড়িহাট্টা দেখলাম, দেখলাম বনানী ট্র্যাজেডি কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো কী করেছে বা করতে পেরেছে? আমরা শুধু ক্ষত স্থানে সাময়িক মলম লাগাতে পেরেছি, ক্ষত সারাতে পারিনি।

স্ত্রী তার স্বামীর খোঁজে এসেছেন তার কান্নায় বাতাস ভারী হয়েছে। বাবা তার ছেলের ফোন পেয়ে উদ্ধারে এসেছেন, বন্ধুরা তাদের বন্ধুর জন্য এসেছেন, কত বোন তার ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন, তারা তাদের স্বজনদের জীবিত পেয়েছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই, তবে তাদের আহাজারি আমাদের ব্যথিত করেছে আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। আমাদের সম্মানীত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সারাক্ষণ খবর রাখছেন, উন্নত ও বিনা মূল্যে সেবা দেবার কথা বলেছেন এটা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের বড় পাওনা।

অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি নিজে ও তার পরিবার, কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ব্যাংক, বিমা কোম্পানিসমূহ। এই ধরনের দুই-চারটা ঘটনা ব্যক্তি, ব্যাংক-বিমার দেউলিয়াত্বের জন্য যথেষ্ঠ। এদের বাইরে আর কারো হারাবার নেই; অন্যেরা কেবল এই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ থেকে কিভাবে আয় করবে তা নিয়েই ব্যস্ত। যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায় তখন তার পরিবারকে মৃত ব্যক্তির লাশ নিতে মেডিকেল বিল, হিমঘর, সুরত হাল রিপোর্ট, প্রশাসন বিভিন্ন জায়গায় যার যা প্রাপ্য বাধ্যতামূলক পরিশোধ করে তবেই লাশ বাড়ি নিতে হয়। যদি কেউ মুতু্যবরণ না করেন তবে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে সারাজীবন সংসারের লোকজনের দয়া দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে তাকে বাঁচতে হয়। এখানে ব্যক্তি অসহায়, নিয়তিই তার ভরসা।

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত্থ হয়, তখন মালিকের ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক প্রথম আক্রমণের স্বীকার হন তিনি। তার প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে তিনি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন, সে দিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। এফ আর টাওয়ারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু যাদের তদারকি করার কথা, তাদের গাফিলতের কথা আমরা একবারও বলি না এবং তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাই না। হায় নিয়তি !

ক্ষতিগ্রস্ত মালিককে তার কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির জন্য সার্টিফিকেট আনতে থানা বা দমকল বাহিনীর মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে তা সংগ্রহে যে কি পরিমাণ কষ্ট ভোগ করতে হয় তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই, তার পরেও হাদিয়া তো আছেই। মানুষের চরম দুর্যোগের সময়ও আমাদের সেবা খাতের এমন নমুনায় সত্যি বিস্মিত হতে হয়। আর এসব ডকুম্যান্ট ছাড়া বিমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ও সম্ভব নয়। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

সিটি করপোরেশনে যাবেন নতুন ট্রেড লাইসেন্স করতে বা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে তখন বুঝবেন আরো কিছু। চুড়িহাট্টায় কেমিক্যালের দোকান/গোডাউনের লাইসেন্স না দেয়ার কথা থাকলেও লাইসেন্স কেন ইসু্য করা হলো? কারা করল? সেদিকে না গিয়ে মালিকদের লোভ আর ব্যবসায়ীদের ব্যবসার উপযুক্ত স্থান নির্বাচনকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। যে কর্তৃপক্ষ ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করলেন তাদের ব্যাপারে আমরা কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি ?

রানাপস্নাজার পর তাজরিন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় আমরা কার্যকর কি ব্যবস্থা নিতে পেরেছি? বনানীর এফ আর টাওয়ার রাজউকের ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে কিভাবে ২৩তলা করা হলো তা আজ প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু এটা হার্ট অব দি টাউন। এর মধ্যে যেখানে এই ধরনের বিল্ডিং করতে ১০-১১টা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন লাগে, সেখানে এই ধরনের বিল্ডিং কারো তদারকি ছাড়া কিভাবে তৈরি হয়? এত বড় বিল্ডিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে অগ্নি নির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং এক্সটিংগুইশার, স্প্রিংগলার ও হাইড্রেন, সিস্টেম ইত্যাদি দেখার দায়িত্ব কাদের? আরো জানা যাচ্ছে এফ আর টাওয়ার ভুল নকশায় তৈরি। ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য দমকল বাহিনী নোটিস দিয়েই খালাশ। আবার ধোঁয়া নির্গমনের যথাযথ ব্যবস্থা নেই, নির্গমন সিঁড়িতে ত্রম্নটি। তাহলে যে ডেভেলপার কোম্পানি এটা তৈরি করলেন তাদের ব্যাপারে কি এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ আছে ?

এখন সবার মায়া কান্না বাতাস ভারী করছে, সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেছেন, বড় বড় ইমারত তৈরির নকশা, যথাযথ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা সঠিক আছে কিনা খুঁটিয়ে দেখবেন। আমরা এর সঙ্গে আরো বলবো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কার্যকর কিনা তা দয়া করে পরীক্ষা করবেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্ঘটনার সময় যন্ত্র কাজ করে না, তা যেন না হয়। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় বিল্ডিংয়ে স্প্রিংগলার ও হাইড্রেন সিস্টেম কার্যকর কিনা এবং পানির সংস্থান আছে কিনা, না থাকলে কি করণীয় তা নিশ্চিত করবেন। আপনার যথাযথ উদ্যোগই শুধু নয়, বাস্তবায়নের সক্ষমতাই বড় বড় হাই রাইজ বিল্ডিং, গার্মেন্টস, মিল ও ফ্যাক্টরি বিরাট ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে। জানমালের ক্ষতি কম হবে, নির্বিঘ্নে দেশের অর্থনীতি বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাবে।

এই কথা বলতে না বলতেই ৩০ মার্চ ২০১৯ইং ভোরে আবার গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেটে অগ্নিকান্ডে প্রায় দেড় শতাধিক দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। এর পেছনে কি কাজ করছে, শক্ত হাতে দেখা দরকার। প্রায় দুই বছরের মধ্যে ব্যবসায়ীদের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আবার বিপর্যয়। নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো এই বিপর্যয়ে অগ্নি দাবি দিতে দিতে দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং কথায় নয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষতি লাঘবে সাহায্য করবেন।

গুলশান-১ এবার আগুন লাগার পর প্রথম আলোর খবর, একজন ভুক্তভোগী আক্ষেপ করে বলছেন, শুধু কথাই হয়, কাজ হয় না। আমরা কিভাবে বাঁচবো ?

সরকারের সব বিভাগ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মুক্ত মনে মুক্ত হস্তে সহায়তার মাধ্যমে দেশ বিনির্মাণে কাজ করবে এটাই সাধারণ জনগণ তাদের কাছে প্রত্যাশা করে।

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্সু্যরেন্স কোম্পানি লিমিটেড

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<44772 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1