শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসন্ন ঈদ ও সড়ক-মহাসড়ক পরিস্থিতি

বেসরকারি বাসচালক- হেলপারদের শতকরা ৯০ ভাগ বেপরোয়া, তাদের যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বহু ক্ষেত্রে মহিলা যাত্রীদের ওপর যৌন ও অপরাপর নির্যাতন এবং কথায় কথায় যাত্রীভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাভাবে যাত্রীপীড়নে যাত্রীসাধারণ বিক্ষুব্ধ। তাই সড়ক-মহাসড়কে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বন্ধ করে সেখানে সরকারি যানবাহন (বিআরটিসি) বিপুল সংখ্যায় নামিয়ে অবিলম্বে ভারসাম্য সৃষ্টি করা জরুরি।
রণেশ মৈত্র
  ২৫ মে ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গর্বিত সন্তানদের ইতিহাস হয়ে যাওয়া 'নিরাপদ সড়কে'র দাবিতে ঘটে যাওয়া আন্দোলনকে কার্যত ব্যর্থ প্রমাণ হয়ে গেছে। ঘটনাবলি যেভাবে ঘটে চলেছে তাতে তাই মনে হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিস্ময়ে দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়, অবশ্য অনেক আগে, মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সড়ক-মহাসড়কে ধীর গতিসম্পন্ন কোনো যানবাহন চলতে দেয়া হবে না। অর্থাৎ রিকশা, টেম্পো, স্কুটার, ইঞ্জিন চালিত রিকশা, নসিমন, করিমন এবং এই জাতীয় অপরাপর যানবাহন চলতে দেয়া হবে না।

তা হলে বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে কোন কোন যানবাহন চলবে। সরকারি ভাষায় 'দ্রম্নত গতিসম্পন্ন'। আমরা জানি, সর্বাধিক দ্রম্নত গতিসম্পন্ন যে যানটিকে সকলে চিনি সেটি হলো উড়োজাহাজ। কিন্তু সেটি যেহেতু সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে চলে না- তাই সে প্রসঙ্গে উঠে না। এখন তা হলে কোন কোন যানবাহনকে চলতে দিতে চায় সরকার সব নাগরিকের (গরিব বড়লোক নির্বিশেষে) অর্থে নির্মিত ওই সড়ক-মাহসড়কগুলোতে? সেগুলো কার, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, বাস, ট্রাক প্রভৃতি। এগুলোর মালিক কারা? ধনীরা। আর ধীর গতি সম্পন্ন রিকশা, ভ্যান, টেম্পো, স্কুটার, নসিমান, করিমন প্রভৃতির মালিক কারা? দেশের গরিবরা। এই উভয় ধরনের যানবাহনের যাত্রীও কিন্তু ভিন্ন শ্রেণির। দ্রম্নতগতি সম্পন্ন যানবাহনের যাত্রী ধনীরা এবং ধীর গতি সম্পন্ন যানবাহনের যাত্রী অতি দরিদ্ররা।

তা হলে কী দাঁড়ালো?

নিঃসন্দেহের বলা যায়, সরকার চাইছেন ধনীদের যানবাহন ধনী যাত্রীদের নিয়েই চলুক প্রধানত, গরীবের টাকায় নির্মিত ঐ সড়ক-মহাসড়কগুলো দিয়ে। এমন সিদ্ধান্ত যারা নিলেন তারা কারা? এটা সত্য, পরিবহন মালিক ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট পরিবহন শ্রমিক নেতারা যাদের দৌরাত্ম্যে অহরই সড়কে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। এই মালিক-শ্রমিক নেতারাই কোনো অভিযোগে কোনো মালিক বা শ্রমিক কারারুদ্ধ হলে বা আদালত কাউকে বিচার করে সাজা দিলে সড়ক পথে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নানা মেয়াদের হরতাল/ধর্মঘট বিনা নোটিসে ডেকে হামেশাই অচল করে দিয়ে থাকে এবং সরকার দ্রম্নতই মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদের রাজার হলে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। ওই মালিক- শ্রমিক নেতারাই পুলিশকে আইন মোতাবেক কাজ করতে নানাভাবে বাধ্য করে থাকে। এ পরিবহন মালিকরা ঈদ যাত্রীদের কাছ থেকে বে-আইনিভাবে কী বিপুল অংকের টাকা ভাড়া হিসেবে আদায় করে থাকে, সারা বছরই বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন সড়কে অতিমাত্রায় ভাড়া দিতে যাত্রীদের বাধ্য করে যাকে- সরকার, মন্ত্রণালয় সবাই তখন নিশ্চুপ। আইন ও যেন তখন অন্ধত্বে ভুগতে থাকে।

বাকি আলোচনায় যাওয়ার আগে বিনীতভাবে সামান্য কয়েকটি প্রশ্ন করি এবং অবশ্যই তা জনস্বার্থে।

এক. বি.আর.টি.সি বাস (একতলা দোতলা নির্বিশেষে) কি ধীর গতিসম্পন? আমরা তো জানি তা দ্রম্নতগতিসম্পন্ন বাসের পর্যায়েই পড়ে না। তেমনি একই পর্যায়ে অবশ্যই পড়ে বিআরটিসির ট্রাকগুলোও।

তা হলে ও গুলো কি সড়কপথে মানুষ হত্যার দায়ে অপরাধী বলে চি?িহ্নত হয়েছে এবং সে কারণেই কি দেশজোড়া বিআরটিসির টার্মিনালগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ঘাস আগাছা প্রভৃতির জন্য রাখা হয়েছে এবং সকল বিআরটিসি যানবাহনকে সারাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে? বাস্তব চিত্র তো তাই বলে। সারাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিআরটিসি টার্মিনালগুলোতে গরু চরছে ঘাস-আগাছায় জঙ্গল পূর্ণ হচ্ছে- সন্ত্রাসীদের নানাক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে-বাস-ট্রাকগুলো কোথায় সংগোপনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা শহরে নিতান্ত অসহায়ভাবেই যেন কোনো কোনো রুটে দু'চারটি বিআরটিসি বাস চালানো হচ্ছে। জনগণের চাহিদা বিআরটিসি টার্মিনালগুলো চালু করা হোক- প্রতি জেলায় কমপক্ষে ৫০টি করে বিআরটিসি বাস ও ৩০টি করে ট্রাক চালু করা হোক এবং যাতে সরকারি ও বেসরকারি পরিবহনগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে, পরস্পর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে তা নিশ্চিত করা হোক। জনগণের এই চাহিদার কারণ, বিআরটিসি বাসগুলো সময়মতো ছাড়ে ও চলাচল করে তাদের চালক-হেলপারসহ কর্মীদের ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্র এবং তাদের সেবার মান তুলনামূলকভাবে ভালো।

বেসরকারি বাসচালক- হেলপারদের শতকরা ৯০ ভাগ বেপরোয়া, তাদের যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বহু ক্ষেত্রে মহিলা যাত্রীদের ওপর যৌন ও অপরাপর নির্যাতন এবং কথায় কথায় যাত্রীভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাভাবে যাত্রীপীড়নে যাত্রীসাধারণ বিক্ষুব্ধ। তাই সড়ক-মহাসড়কে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বন্ধ করে সেখানে সরকারি যানবাহন (বিআরটিসি) বিপুল সংখ্যায় নামিয়ে অবিলম্বে ভারসাম্য সৃষ্টি করা জরুরি।

দেশবাসী চান বিআরটিসির সব যান চলাচল করুক। একতলা-দোতলা নির্বিশেষে ওই যানবাহনের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বাড়ানো হোক। কিন্তু বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকরা ওই ধনী পরিবহন মালিকদের অবৈধ এবং এখতিয়ার বিহীন দাবির পক্ষে বলে বিআরটিসির যানবাহনগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছেন?

লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ভাঙ্গাচোরা গাড়িগুলো শুধু রং বদল করেই মালিকেরা যে সেগুলো সড়ক-মহাসড়কে চালিয়ে যাত্রী সাধারণের জীবন বিপন্ন করছে- হতাহত করছে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীর- তার কার্যকর কোনো সুরাহা হয়েছে কি ? সেগুলো কেন জব্দ করা হয় না- জব্দ করে ভেঙেচুরে ফেলে যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বা বাধা কোথায়?

চালকদের প্রশ্নে আসা যাক। একজন চালকের ওপর নির্ভর করেই ৫০/৬০ জন যাত্রী- নারী-পুরুষ লিপ্ত নির্বিশেষে বাড়িতে ওঠেন। মালিকও কোটি টাকার গাড়িটা ওই চালকের হাতেই তুলে দেন। সেই চালক যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণবিহীন হন তবে কাকে দায়ী করা যাবে? ধনি চালককে টাকার বিনিময়ে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিলেন সেই সরকারি কর্মকর্তা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু সেই কর্মকর্তা যখন দেখেন শ্রমিক নেতা নামে একজন মন্ত্রী ওই চালককে নাম-কা-ওয়াস্তে প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে লাইসেন্স ইসু্য করতে চাপ প্রয়োগ বা আকারে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন তো শুধুমাত্র যিনি লাইসেন্সটি ইসু্য করলেন এককভাবে তিনি তো দায়ী হতে পারেন না। যিনি ইঙ্গিতে হুকুম দিলেন মসনদে বসে তিনি বাদ যাবে কোন যুক্তিতে?

ধীর গতিতে চলা গরিব মানুষের যানবাহনগুলো কী হবে ? অন্তত কয়েক লাখ চালক বেকার, মালিক উপার্জনহীন এবং যাত্রীদের ব্যয় বৃদ্ধি কি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে? তবে এ কথাও সত্যি যে ধীর গতিসম্পন্ন গাড়িগুলোর সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একটা মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে।

এমতাবস্থায় গরিব যানবাহনের মালিক ও চালকদের বেকারত্ব থেকে রক্ষা এবং গরিব যাত্রীদের স্বার্থ সংরক্ষণের পথও বের করতে হবে। এবং সম্ভব মতো সম্প্রসারণও করতে হবে। মালয়েশিয়াসহ নানা উন্নয়নশীল দেশে এগুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন কমদামি কিন্তু আরামদায়ক তিন চাকা বিশিষ্ট যানবাহন তৈরি করছে।

মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নাসিমন করিমন নামক যানগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল কিন্তু জনগণ তাতে সায় দেয়নি। তারা বলেছে, ওইগুলোর ভাড়া অনেক কম। তা ছাড়া ওই যানগুলো প্রয়োজনমতো থামানোও যায়। ফলে যাত্রীদের বিস্তর সুবিধা হয়। কিন্তু যদি নসিমন করিমগুলো নিষিদ্ধ করা হয় পরিবহন মালিকরা তৎক্ষণাৎ নানা রুটে যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে দেবে কিন্তু যাত্রীদের প্রয়োজনমতো ওঠা নামার ব্যবস্থা হবে না। ফলে সমস্যা জটিলতার হবে। নছিমন, করিমন কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য স্বল্প ভাড়ায় নানা হাট-বাজারে বহন করে থাকে। তাদের বে-আইনি করলে ট্রাক ভাড়াও বাড়বে- বেড়ে যাবে ক্রেতা পর্যায়ে পণ্যমূল্যও। তাই বিষয়টা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ পরিবহন জটিলতা তার স্বল্পতা, তার ভাড়াবৃদ্ধি জনজীবনে ব্যাপক নেতিবচাক প্রভাব ফেলে থাকে। এবং তা কদাপি গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্র।

ঢাকা শহর নিয়ে যেন ভাবতে হবে বারংবার তেমনি সমগ্র বাংলাদেশ নিয়েও বহুবার ভাবতে হবে। পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের কাছে দেশবাসী অসহায়ত্বের শিকারে পরিণত হয়েছে। দিন দিনই তাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যে কারণে আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজ "সড়ক নিরাপত্তার" দাবিতে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তা দেখে যারা আঁতকে উঠেছিলেন তাদেরই একজন প্রধান ব্যক্তি তখনকার প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা ও নৌ পরিবহনমন্ত্রী।

প্রয়োজন বহুবিধ বিকল্প ব্যবস্থারও। যেমন, রেলপথের ব্যাপক সম্প্রাসারণ, নতুন নতুন সড়ক-মহাসড় নির্মাণ, বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়গুলো প্রশস্তকরণ; ধীগতির কোনো বাহন বে-আইনি না করে বাস্তাগুলো চওড়া করে তাদের জন্য সোর্স নির্দিষ্ট করে দেওয়া, কমদামি যানবাহনগুলোর আধুনিকীকরণ; যাত্রী স্বার্থে পরিবহন আইনের পুনঃসংশোধন, চালক প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, লাইসেন্স প্রদান দুর্নীতিমুক্তকরণ, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা সকল যান বাহনগুলো প্রভৃতি। ঈদের আগে পদক্ষেপগুলো জরুরি ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<51003 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1