শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ধানের চেয়ে সিগারেটের কদর কি বেশি?

সরকার চাইলে তো সিগারেট কোম্পানি বন্ধ করে দিতে পারে। নাকি তামাকের মূল্য বাড়িয়ে তামাক চাষে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে? কৃষক ধানের দাম পায় না আর শিল্পপতিরা সিগারেট বিক্রি করে আরও ধনী হচ্ছে।
আবু জাফর সিদ্দিকী
  ২২ জুন ২০১৯, ০০:০০

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিড়ি ও সিগারেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ধূমপানবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান, তামাকজাত পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় এর ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে এ দাম বাড়ানো হচ্ছে।

আগামী বছর নিম্নতম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ টাকা। সেখানে সম্পূরক শুল্ক ধরা হয়েছে ৫৫ শতাংশ। মধ্যম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য হবে ৬৩ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ। উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য হবে ৯৩ টাকা ও ১২৩ টাকা। এখানে সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী নিম্নতম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের দাম ৩৫ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৫৫ শতাংশ। মধ্যম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য ৪৮ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ। উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের দাম ৭৫ ও ১০৫ টাকা। এখানে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ।

তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা ও আত্মা বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে কর হার ও স্তরসংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাবে তামাক কোম্পানি লাভবান হবে।

সংগঠন দুটির বিবৃতিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। শুধু মূল্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৬৩, ৯৩ ও ১২৩ টাকা। এতে সিগারেট কোম্পানিগুলোকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

সংগঠন দুটি বলছে, তামাক ব্যবহারজনিত মৃতু্য ও অসুস্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলোকে লাভবান করার এই বাজেট চরম হতাশাজনক, জনস্বাস্থ্যবিরোধী।

এ বছর উৎপাদিত খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে ধান। সারাদেশে ধানের মূল্য বৃদ্ধির জন্য হয়েছে নানা রকমের আন্দোলন। কৃষক তার কষ্টার্জিত ধানে আগুন দিয়েছে, শুধুমাত্র দাম কম হওয়ায়। অথচ সরকার বাজেটে ধানের মূল্য বৃদ্ধির কথা না ভেবে বৃদ্ধি করেছে সিগারেটের দাম। যা অত্যন্ত হতাশার। জাতি মর্মাহত। এ বছর পানির দামে ধান বেচে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে কৃষকদের। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে গরু-ছাগল বিক্রি করছেন। বোরো মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও ও গ্রামীণ সমিতি থেকে ঋণ করে চাষাবাদ করেন। মৌসুম শেষে ফসল বিক্রি তারা ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু এ বছর ধানের দাম কম, ফসলের ফলন কম হওয়ায় ও ফসলের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচের টাকাও ঘরে তুলতে কৃষককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে দেশের কৃষকদের মধ্যে নেমে এসেছে চরম হতাশা।

কৃষিশুমারি অনুযায়ী দেশে ১ কোটি ৪৫ লাখ কৃষকের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড রয়েছে। সরকার ২ কোটি ৮৬ লাখ কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এর মধ্যে এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক আছেন। সাধারণত তারা উৎপাদিত ধানের অর্ধেকের বেশি বিক্রি করে ঋণ শোধ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন। ধানের দরপতনে ওই এক কোটি ক্ষুদ্র কৃষক ও তাদের পরিবারের পাঁচ কোটি সদস্য এখন হতাশায় ভুগছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

এ বছর ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠেনি। এবার কৃষকরা বিঘাপ্রতি প্রায় ১০/১২ হাজার টাকা খরচ করে ফলন পেয়েছেন ১৮/২০ মণ ধান। বাজারে ধানের দাম না থাকায় কৃষকদের বিঘাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে দু'আড়াই হাজার টাকা। ধান বিক্রি করে সার, তেল, কীটনাশকসহ শ্রমিক মজুরির দাম ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। এমন অবস্থা বিরাজ করলে আগামীতে ধান চাষে বিমুখ হবেন সাধারণ কৃষকরা। সরকারিভাবে প্রতি মণ ধানের বিক্রয় মূল্য এক হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৭০০-৭৫০ টাকা দরে। সরকারি গুদামে চাল দিতে চালকল মালিকরাও বাজারে ধান ক্রয় শুরু করেননি। ফলে ধানের বাজারে আসছে না কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যেসব কৃষকের জমি ৫০ শতাংশের নিচে। এমন কার্ডধারী কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান বিক্রির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে কৃষি বিভাগ বা ইউনিয়ন পরিষদের দেয়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অন্যথায় এ সুযোগ পাবেন না কৃষকরা। তবে কৃষকরা বলছেন, কয়েক বছর আগে কৃষি বিভাগ কৃষকদের ভর্তুকির বীজ ও সারের জন্য কৃষিকার্ড করে দেন। সেই সময় কার্ডে উলিস্নখিত জমির পরিমাণ অনুযায়ী কৃষক সার ক্রয় করতে পারতেন। তাই সারের চাহিদা মেটাতে কম জমির বর্গা চাষিরাও অধিক সংখ্যক জমি দেখিয়ে কার্ড করেছেন। ফলে আয়তনের চেয়েও কৃষকের জমির পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। ইচ্ছামত জমি দেখিয়ে কৃষক কার্ড করায় বর্গাচাষিরাও পড়েছেন অনেকটা বিপদে। ঋণ করে অল্প জমিতে ধান করেও কার্ডে ভুলের কারণে তারা ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না। এ ছাড়াও অনেকেই ধান চাষ না করেও তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে ধান বিক্রির খাতায়। ফলে প্রকৃত চাষিরা বঞ্চিত হয়েছেন।

সবাই জানি, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। জানলেও মেনে চলেন আর ক'?জন?? ধূমপানের কারণে অল্প বয়সেই ত্বকে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিগারেট শুধু ত্বক নয়, দাঁতের ক্ষতিও করে। সিগারেটের নিকোটিনের কারণেই দাঁতের ঝকঝকে সাদা রঙ পালটে হলদেটে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে চুলেরও ক্ষতি হয়। শুধু বলিরেখা নয়, অধিক ধূমপানের ফলে ত্বকের আরো অনেক সমস্যা দেখা দেয়। সিগারেট এ যুগের ফ্যাশন বলা যায়। সিগারেট খেলে স্মার্ট হয় আর না খেলে আন-স্মার্ট, এমনটাই ভাবে আজকাল অনেকে। বর্তমানে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সিগারেট খাচ্ছে। আমরা যা ভেবেই সিগারেট খাই না কেন, এটা কিন্তু জানি যে সিগারেট মানুষের দেহের ক্ষতি করে। কিন্তু যা জানি না তা হলো ঠিক কীভাবে ক্ষতিটা করে। সিগারেট কাউকে একদিনে ধ্বংস করে দেয় না। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এর কুফল দেখা দিতে থাকে।

মানবদেহে সিগারেটের ধ্বংসাত্মক পরিণতি-

১. সিগারেটের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়। ২.হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক ঘটায়। ৩.ধমনীতে (করনারি আর্টারি) বস্নকেজ তৈরি করে। তখন এনজিওপস্নাস্টি করে আর্টারিতে রিং পরাতে হয়, এই রিং ১০ বছরের মতন থাকে। এরপর অবস্থার উন্নতি না হলে বাইপাস সার্জারি (ওপেন হার্ট) করানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

সরকার চাইলে তো সিগারেট কোম্পানি বন্ধ করে দিতে পারে। নাকি তামাকের মূল্য বাড়িয়ে তামাক চাষে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে? কৃষক ধানের দাম পায় না আর শিল্পপতিরা সিগারেট বিক্রি করে আরও ধনী হচ্ছে।

যে দেশ কৃষি প্রধান, সে দেশের সরকার কৃষকের কথা না ভেবে ভেবেছে শুধু শিল্পপতিদের কথা, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

আবু জাফর সিদ্দিকী: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<54661 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1