শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ ও প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগ ছাড়া টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়

রবীন্দ্রনাথ বলতেন, 'আমাদের দেশে আমাদের পলস্নীতে ধান উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায় অপরিহার্য।' শিলাইদহে তিনি তার এই ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিকে একত্রিত করে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কাজে হাত দিয়ে ছিলেন এবং কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন।
নিতাই চন্দ্র রায়
  ০৫ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

'একটি গ্রাম জাগলে, একটি দেশ জাগবে।' এই জীবন দর্শন রবীন্দ্রনাথকে তার পলস্নী উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিশ্বকবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষি উন্নয়নকে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি বলে জানতেন।

\হসে জন্য নানা প্রকল্পও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার জমিদারিতে কৃষি এবং কৃষি সম্পর্কিত নানা কর্মকান্ডের উন্নয়নের জন্য তিনি তার নোবেল পুরস্কারের সব অর্থ দিয়ে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রাশিয়ার অনুরূপ কৃষি ক্ষেত্রে একত্রিকরণের পরিকল্পনাও করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কৃষির পাশাপাশি শিল্পের উন্নয়নও করতে চেয়ে ছিলেন। তিনি তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প ও চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পও গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আনতে চেয়ে ছিলেন এবং তার কর্মক্ষেত্রে আলু চাষেরও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলতেন,' চাষিকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে- এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্পর্কে দুটো কথা সব সময় আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে- জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়- সে চাষির। দ্বিতীয়ত, সমবায় নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্রে একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্দাতার আমলের হাল, লাঙল নিয়ে আলবাঁধা, টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসিতে জল আনা একই কথা।' রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছিলেন, পলস্নীর উন্নয়ন কৃষির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। উন্নত প্রথার কৃষির ব্যবস্থা না হলে পলস্নী অঞ্চলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি তার কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে কৃষি শিক্ষার জন্য ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ছিলেন। শিক্ষা শেষে জামাতা নগেন্দ্রনাথ এবং পুত্র রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ তাদের শিলাইদহে কৃষি উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করেন।

\হরবীন্দ্রনাথ বলতেন, 'আমাদের দেশে আমাদের পলস্নীতে ধান উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায় অপরিহার্য।' শিলাইদহে তিনি তার এই ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিকে একত্রিত করে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কাজে হাত দিয়ে ছিলেন এবং কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন।

বাংলাদেশে বড় কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষকের শতকরা ২ ভাগ, মাঝারি কৃষক ১৮ ভাগ এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ। ধান, আলু, ভুট্টা, শাকসবজি ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশে আজ যে বিস্ময়কর সফলতা অর্জিত হয়েছে- সে কৃতিত্বের দাবিদার এই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরাই। এসব কৃষকেরই ফলন বেশি। তারাই কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি সময় মতো মাঠে প্রয়োগ করেন। সময় মতো ফসলের পরিচর্যা করেন। পোকা-মাকড় ও রোগবালই দমন করেন। জমি তৈরি, বীজ, সার ও বালাইনাশক ক্রয়, সেচ প্রদান, আগাছা দমনসহ নানা কাজে কৃষকের নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। কৃষক তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ( এনজিও), সুদখোর মহাজন ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। খাদ্যনীতি পারমর্শবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টার ন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক ও দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ গ্রহণ করেন। কী ভয়ঙ্কর কথা! এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। তাহলে কৃষক বাঁচে কিভাবে? আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেয়, তা কৃষক খুব সামন্যই পান। কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে। ২০১৫ সালে করা ওই সমীক্ষার সুপারিশ গত ২০ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে উপস্থাপন করে ইফপ্রি। সংস্থাটি বলছে, কৃষকে লোকসান থেকে বাঁচাতে হলে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণের ফলে ধানের উৎপাদন খরচও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অনেক বেশি। ভারতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, দেশটিতে চলতি বছর প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। আর সরকারি সংগ্রহ মূল্য ২০ টাকা ৮০ পয়সা। অন্যান্য প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে এ বছর প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে ২০ টাকারও কম। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ২৫ টাকা এবং সরকার নির্ধারিত ক্রয় মূল্য ২৬ টাকা। কৃষক সরকারের কাছ থেকে যেমন ঋণ কম পাচ্ছেন, তেমনি সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধানও কিনছে কম। মাত্র ৪ লাখ টন ধান এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে সরকার। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করা যায়, উৎপাদন গত বারের ১ কোটি ৯৬ লাখ টনকেও ছাড়িয়ে যাবে। বোরো ধান কাটার সময় প্রতিবারের মতো এবারও শ্রমিকের সংকট ছিল তীব্র। এলাকা ভেদে প্রতিজন কৃষি শ্রমিককে দিনে মজুরি দিতে হয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। অন্যদিকে কৃষককে বোরো ধান বিক্রি করতে হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে। এতে তাদের উৎপাদন খরচও উঠেনি। এ অবস্থায় অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের পক্ষে সময় মতো কৃষি ঋণ পরিশোধ করাটা সম্ভব হবে না। এব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের বক্তব্য হলো- কৃষি ব্যাংকের সুদের হার অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম। কিন্তু এই ব্যাংকের ঋণ দেশের কৃষকদের বড় অংশ পায় না। কারণ একদম গ্রামীণ পর্যায়ে এই ব্যাংকের শাখা নেই। কিন্তু এনজিওদের শাখা আছে। ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষি ব্যাংকের আরও শাখা খুলতে হবে। তহবিলও বাড়াতে হবে। ইফপ্রির সমীক্ষায় দেখা গেছে, কৃষকরা কৃষি কাজের জন্য যে ঋণ গ্রহণ করেন, তার সবচেয়ে বড় উৎস হলো এনজিও। সেখান থেকে আসে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণ। এরপরই তারা ঋণ নেন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। ওই ঋণের পরিমাণ ১৯ শতাংশ। জমির মালিকদের কাছ থেকেও অগ্রিম টাকা ঋণ হিসেবে নেন কৃষক। এই ঋণের পরিমাণ ১৫ শতাংশ। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আসে ১১ শতাংশ ও সমিতিগুলো থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষি ঋণ। সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকে আসা ঋণের পরিমাণ ৬ শতাংশের মতো, যার বেশি অংশ পান বড় চাষিরা। প্রায় ১৫ শতাংশ বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে ৩৬ শতাংশ ঋণ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান ৫ শতাংশের মতো। বর্গাচাষিরা কৃষি ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ পান না। তাদের এনজিওসহ অন্যান্য উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়। এব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য হলো- কৃষি ব্যাংক প্রতিবছর ৩ লাখ ৩৫ হাজার কৃষককে ৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দিয়ে থাকে। এ বছর নতুন করে ১ লাখ ৬৫ হাজার কৃষককে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি সুদ নেন সুদের কারবারিরা। তারা ৬৩ শতাংশ হারে সুদ দেন। কৃষক মূলত জরুরি কৃষি উপকরণ সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের খরচ জোগাতে এসব ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। কোনো জামানত ছাড়াই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিইে এসব ঋণ দেয়া হয়। ঋণের সুদের ক্ষেত্রে দাদন ব্যবসায়ীদের পরই রয়েছে এনজিও। এই খাত থেকে বছরে সোয়া লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় বাংলাদেশ পলস্নী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সদস্য এনজিওগুলো। তারা সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ হারে সুদ নিয়ে থাকে। মূলত বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে তিন থেকে পাঁচ মাস সময়ের জন্য এসব ঋণ দেয়া হয়। এব্যাপারে বাংলাদেশ পলস্নী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলো, কৃষকের যাতে লোকসান না হয় সে জন্য উৎপাদন খরচ কমানো জরুরি। পিকেএসপি ধারাবাহিক হারে কৃষি ঋণের সুদ কমাচ্ছে। দ্রম্নত ও কার্যকরভাবে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছেন সংস্থাটি। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের গ্রামীণ ঋণের একটি অংশ কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করে। তাদের গড় সুদের হার ১৩ শতাংশ। এর বাইরে বিভিন্ন সমিতি থেকে নেয়া সুদের হার ১৯ শতাংশ। মূলত বিভিন্ন সমবায় সমিতি এই ঋণগুলো দিয়ে থাকে। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদের হার ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষকরা সাধারণ এসব ঋণ নিয়ে কৃষি উপকরণ কিনে থাকেন। তারা স্বল্প সুদে ও সহজে এসব ঋণ পেলে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কমে যেত। ফলে প্রতিবছর কৃষক ধানে ও সবজিতে যে লোকসান দিচ্ছেন, সেটা হতো না। কৃষি ঋণের সুদের হার কমিয়ে তা কৃষকের জন্য সহজলভ্য করা না গেলে লোকসান কমানো যাবে না। খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকেও কৃষককে বাঁচানো যাবে না। কৃষক যে কাজের জন্য ঋণ গ্রহণ করেন, ঋণের অর্থ যদি সেই কাজে সময়মতো সঠিকভাবে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সে ঋণ কোনো সময় অনাদায়ী থাকে না। কৃষক হাসতে হাসতে স্বইচ্ছায় ঋণ পরিশোধ করেন এবং নতুন ঋণ গ্রহণ করেন। কৃষি ঋণ বিনিয়োগের সঙ্গে মাঠে কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সঠিক কৃষক নির্বাচন ও ঋণ বিনিয়োগ নীতিমালা। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেয়া যাবে না কোনো ক্রমেই। এটা করা গেলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। কৃষক লাভবান হবেন। ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে আমাদের অন্নদাতা কৃষকের নামে হাজার হাজার সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করতে হবে না। চাকরি জীবনের ৩২টি বছর আমি কৃষি, কৃষক, কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি ঋণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। শত শত কৃষকের অনাদায়ী ঋণের ঘটনার তদন্ত করেছি। এ আলোকে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি- ঋণ ও কৃষি প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগ ছাড়া টেকসই কৃষি উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

নিতাই চন্দ্র রায়: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<56799 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1