শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ-গণধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় বের করার এখনই সময়

শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকদের থাবা থেকে। জাতীয়ভাবে বড় প্রতিবাদ না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন জোরালো ভূমিকা দেখা যায় না। সাধারণত দরিদ্র ও দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়। দীর্ঘমেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তাদের পরিবার দিতে পারে না। সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। এদের পাশে কে দাঁড়াবে?
আর কে চৌধুরী
  ০৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

কুষ্টিয়ার পান্না মাস্টার, ভিকারুননিসার পরিমল চন্দ্র জয়ধর, সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার মতো নৈতিকতা বর্জিত একশ্রেণির শিক্ষকের লাম্পট্যে বহু ছাত্রীর সর্বনাশ ঘটেছে। গত পাঁচ বছরে সারাদেশে সহস্ররাধিক ছাত্রী এসব শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার হয়েছে। একই রকম বর্বরতার ফাঁদে আটকে আছে আরও অসংখ্য ছাত্রী। তাদের কারও শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, চুরমার হয়েছে সব স্বপ্ন। শিক্ষক নামধারী কিছু লম্পটের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিশু ছাত্রীরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না।

শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন পীড়নের অভিযোগ এনে জীবন দিতে হয়েছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে। তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল নৃশংস এই ঘটনা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই বর্বর ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ-মানববন্ধন হয়েছে। সর্বত্রই এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে অনেকে। কিন্তু দেশ নাড়িয়ে দেয়া এ ঘটনা কি রিরংসাপ্রবণ পুরুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছে? তেমনটি হলে তো নারী ও শিশুর প্রতি যৌন পীড়নের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না।

\হদেশের সর্বত্র যৌন পীড়নের ঘটনা ঘটছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করেছে সাত দুষ্কৃতকারী। মোবাইল ফোনে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেছে তারা। সিলেটে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক তরুণী। বগুড়ার ধুনটে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। নওগাঁয় দুই ও রাজবাড়ীতে এক স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহে শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কুমিলস্নায় ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নওগাঁয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, বরগুনা, ময়মনসিংহ এবং ঝালকাঠি থেকেও ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগের খবর এসেছে সংবাদপত্রে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব খবরে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ ধরনের অনাচার চলতেই থাকবে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বলতে দ্বিধা নেই, সমাজচিত্র আজ অনেকটাই বদলে গেছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখন মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগে যে সম্পর্ক ছিল, তা এখন নেই বললেই চলে। সামাজিক অনুশাসন বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। ফলে অনাচারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও যেন অপরাধীদের উসকে দিচ্ছে। আর সে কারণেই শাস্তির একটা বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

শিক্ষকতার মতো সম্মান আর মর্যাদাপূর্ণ পেশার আড়ালে যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠছেন কিছু শিক্ষক। ফলে আদর্শবান শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। আর আস্থাহীনতায় ভুগছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, ছেলেমেয়ে শিক্ষকের কাছে থাকলে তারা নিরাপদ মনে করেন। কিন্তু শিক্ষক নামধারী কিছু শয়তান এসব কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন তারা। শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষকতার চাদর মুড়ি দিয়ে যারা যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠেছেন তারা শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নয়। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পিতৃতুল্য শিক্ষকদের এসব জঘন্যতায় ছাত্রীরা যেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তেমনি অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী কমিটিসহ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় নব্বই শতাংশের ওপরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয় না। লোকলজ্জা, পারিবারিক ও সামাজিক লজ্জার কারণে এসব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শুধু ধর্ষণ নয়, একই সঙ্গে ধর্ষণ ও হত্যার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে এরই মধ্যে।

শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকদের থাবা থেকে। জাতীয়ভাবে বড় প্রতিবাদ না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন জোরালো ভূমিকা দেখা যায় না। সাধারণত দরিদ্র ও দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়। দীর্ঘমেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তাদের পরিবার দিতে পারে না। সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। এদের পাশে কে দাঁড়াবে?

বিপরীত দিকে অর্থবিত্ত বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদদপুষ্টরাই ধর্ষণের মতো অপরাধ করে। ফলে এসব ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে গরিমসি করে, মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে, অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেয় কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায় না। এরকম অভিযোগ অজস্র।

স্বীকার করতেই হবে যে, ধর্ষকরাও আমাদের সমাজেরই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের বখে যাওয়ার দায় রয়েছে পরিবার-সমাজেরও। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, এটাও স্পষ্ট।

মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গেও এরকম অপরাধের হার বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, লাগাম টেনে না ধরা গেলে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে। ধর্ষণ প্রতিরোধে জরুরি অপরাধীর যথার্থ শাস্তি নিশ্চিত করা। দুর্বল ভিকটিমদের পক্ষে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।

অপরাধ তদন্তে ও অপরাধীদের বিচারাধীন করায় পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি ও সংগঠনকে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা চাই সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনার অপরাধীদের দ্রম্নত খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57154 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1