শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নন্দিত-নিন্দিত এরশাদ

এরশাদকে একজন সফল রাজনীতিবিদ বলা যেতে পারে। সফল না হলে একজন স্বৈরশাসক কী করে দীর্ঘ চার দশক বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে গেলেন? দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ তো এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া ভাবাই যায় না। এই দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। দশম সংসদে রওশন এরশাদ এবং একাদশ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন এরশাদ। এ ছাড়া এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও ছিলেন। শেষ জীবনে একজন স্বৈরশাসকের এর চেয়ে আর বেশি কী পাওয়ার ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে তিনি শেষ দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। দেশের প্রধান দুটো দল এক সময়ে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল- এটা তারা ভুলে গেছে। সম্ভবত এই কারণে বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা শতভাগ সত্য।
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ একই সঙ্গে বিতর্কিত ও আলোচিত চরিত্র। তাকে অনেকেই রহস্য-পুরুষও বলে থাকেন। তাকে দাপুটে ও ক্ষেত্রবিশেষে অসহায় রাজনীতিকও বলা যেতে পারে। রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় অগণতান্ত্রিক উপায়ে যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন তাকে স্বৈরশাসক বলা হয়। স্বৈরশাসকের চরিত্র বা কৌশল হচ্ছে বৈধতা অর্জনের জন্য তারা রাষ্ট্রের নানা ধরনের জনকল্যাণকর কাজের দিকে অধিক মনোযোগী হন, পেতে চান জনপ্রিয়তা। স্বৈরশাসকের বাজে ও বিতর্কিত অভিধা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাতারাতি তারা জনদরদী হয়ে ওঠেন। এই প্রবণতা এরশাদের মধ্যে পুরোপুরি ছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতা অবৈধ উপায়ে দখলের পর থেকেই (২৪ মার্চ, ১৯৮২) তিনি দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ (উপজেলা ব্যবস্থার চালু, যা আজও বিদ্যমান), ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন এবং উত্তরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপস্নব ঘটানো তার উলেস্নখযোগ্য ইতিবাচক কাজ। মজিদ খানের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা ভবন ঘেরাও করতে গেলে মারা যান তিন জন। এর ফলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে এরশাদের বিরুদ্ধে। ৯ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। মূলত ছাত্ররাই এরশাদকে গদি ছাড়তে বাধ্য করে। টানা তিনদিন ছাত্ররা রাজপথে অবস্থান করে। এ ঘটনা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নজিরবিহীন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতা গেলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় এরশাদকে। ছয় বছর কারান্তরীণ থাকার পর ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে জামিনে মুক্ত হন এরশাদ। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, জেলে থেকে এরশাদ ৯১-তে নির্বাচন করেছিলেন এবং ৫টি আসন পেয়েছিলেন। তার দল পেয়েছিল ৩৫টি আসন। দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকটি মামলায় তার সাজাও হয়। এখনো কয়েকটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিশেষ করে মঞ্জু হত্যা মামলার আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ১৭টি মামলা। তিনি সবসময় আতঙ্কে থাকতেন কখন জেলে যেতে হয়। ৬ বছর জেল খাটার পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন, যার ধারাবাহিকতায় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবেই মৃতু্যবরণ করেন। তিনি একই সঙ্গে নিন্দিত-নন্দিতও। গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষ তাকে ভালোবাসে, বিশেষ করে রংপুরের জনগণ। এ দেশে যারা রাজনীতির মারপঁ্যাচ বোঝেন না, বোঝেন না স্বৈরাচার কী, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল কী ও গণতন্ত্র হত্যা কী- তাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয় ও নমস্য। বনানী কবরস্থানে তার দাফনের কথা থাকলে শেষ পর্যন্ত রংপুরে পলস্নীনিবাসে তাকে দাফন করা হয় স্থানীয় হাজার হাজার নেতাকর্মীদের বিক্ষোভের মুখে। অনেক নেতাকর্মী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এর দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় তার জনপ্রিয়তার বিষয়টি।

৯০-এর গণ-অভু্যত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেখানে তিনি এরশাদের নামের আগে ১৯টি বিশেষণ দিয়েছিলেন, যার সবই নেতিবাচক ও আক্রমাণত্মক। যা তখনকার পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

\হএরশাদকে একজন সফল রাজনীতিবিদ বলা যেতে পারে। সফল না হলে একজন স্বৈরশাসক কী করে দীর্ঘ চার দশক বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে গেলেন? দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ তো এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া ভাবাই যায় না। এই দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। দশম সংসদে রওশন এরশাদ এবং একাদশ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন এরশাদ। এ ছাড়া এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও ছিলেন। শেষ জীবনে একজন স্বৈরশাসকের এর চেয়ে আর বেশি কী পাওয়ার ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে তিনি শেষ দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। দেশের প্রধান দুটো দল এক সময়ে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল- এটা তারা ভুলে গেছে। সম্ভবত এই কারণে বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা শতভাগ সত্য।

\হএরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে দেশে গণতন্ত্র ছিল না, অথচ উন্নয়ন ও জননিরাপত্তা ছিল, এটা অনেকের মুখে শোনা যায়। এই কথাটা স্ববিরোধীর মতো শোনালেও পুরোপুরি কি মিথ্যা? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, জিয়াউর রহমানও নিহত হলেন, আর এরশাদ! এই প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খেতেই পারে। সেই বিবেচনায় তিনি সফল না তো কে সফল। তার মধ্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল বলেই রাজনীতিতে আমৃতু্য টিকে গেলেন দাপটের সঙ্গে।

\হস্বৈরশাসকরা অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে, রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনিও করেছেন। যেমন করেছেন জিয়াউর রহমান। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে দেশের বাঘা বাঘা নেতারা যোগ দেন, যারা এক সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে ছিলেন। দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তারকাখ্যাত অনেক নেতা এক সময় জাতীয় পার্টি থেকে আজ বিএনপি-আওয়ামী লীগে আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, এম এ মতিন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, এম এ মুহিত, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জুর। এদের বেশিরভাগই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের যোগ দিয়ে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। দু-একজন আলাদা দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগের এক সময়কার প্রভাবশালী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদের জাতীয় পার্টি করেন দীর্ঘদিন। তিনি এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি এরশাদকে ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। এমন উদাহরণ অনেক দেয়া যায়।

বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃতু্যর পর যে কোনো বিশৃঙ্খলায় তার দলে ভাঙন দেখা দিতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব' থাকে। আর দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ 'গণতন্ত্রের অভাব' রয়েছে। এই পটভূমিতে জেনারেল এরশাদের অনুপস্থিতি জাতীয় পার্টির ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যাবে এমন প্রশ্নও উঠে এসেছে।

মূলত জাতীয় পার্টি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়নি। এটি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। জাতীয় পার্টি সুবিধাবাদীর রাজনীতি করেছে। যার কারণে এক সময় ক্ষমতা ভোগ করেছে, এক সময় ছিটকে পড়েছে ক্ষমতার বলয় থেকে। আবার সমন্বয় করে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে ঢুকেছিল। কিন্তু এত সবকিছুই এরশাদকে কেন্দ্র করে ছিল। এটা সবাই জানে জাতীয় পার্টিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। দলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি ধারা রয়েছে। আরেকটি ধারা জিএম কাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন দুটি ধারার একটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে যাবে, আরেকটি অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ ফোরামে বা বিএনপি ফোরামের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। ফলে দ্বন্দ্বটা প্রকট হতে পারে। এর ফলে জাতীয় পার্টিতে ঐক্য না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এরশাদ বিতর্কিত হলেও দলের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন পূজনীয়। তার মৃতু্যর পর পার্টির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অনৈক্য দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক।

এরশাদ কতটা গণতন্ত্রী, কতটা মানবিক ও কতটা প্রেমিক-দেশপ্রেমিক ছিলেন সে প্রশ্নও সামনে চলে আসে। তিনি কাব্যচর্চায়ও মনোনিবেশ করেছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তার দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ পেত। প্রকাশ পেতো অন্যান্য পত্রিকায়ও। মধ্যযুগে রাজকবি যেমন ছিলেন, তেমন রাজা- বাদশা-সম্রাটও কবি ছিলেন। আর আধুনিক যুগে ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার কবিতা নিয়ে বাজারে নানা মুখরোচক কথা চালু রয়েছে। বিদিশা একবার এক টিভি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে নেতিবাচক কথা বলেছিলেন। তবে তার চরিত্রের একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি কখনো একমতে বা সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারতেন না। ঘন ঘন মত-সিদ্ধান্ত পাল্টাতেন। এটা দেশবাসীর কাছে হাস্যকর মনে হতো। তবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি আলোচিত, বিতর্কিত ও রহস্যময় চরিত্র। তার মৃতু্যর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি আলোচিত অধ্যায়ের অবসান হলো।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58631 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1