শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস সঠিকভাবে জানা ও উপলব্ধি করা জরুরি

সাবেক ইকবাল হলটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহিরুল হক সাহেবের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তবে এই সাহসী মানুষদের মূল্যায়নের পক্ষে আমিও। রাষ্ট্র তাদের সেভাবে মূল্য দিলে জাতির কোনো কমতি বা ঘাটতি হবে না। কাজেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই মামলার সাহসী সন্তানদের- যারা মৃতুু্যবরণ করেছেন বা করেননি তাদের জাতীয়ভাবে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মান দিয়ে জাতি তার দায় মুক্তির ব্যবস্থা নিতে পারে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ০১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

একটি জাতির অগ্রগতির জন্য তার দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা ও উপলব্ধি করা অত্যাবশ্যক। একটা দীর্ঘ ও সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটেছে। বহু সংগঠন ও বহু ব্যক্তির নাম এ প্রসঙ্গে অবশ্যই স্মরণীয়। সব দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। ভারত, রাশিয়া, তুরস্ক, চীন, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, কিউবা প্রভৃতি দেশের কথা স্মরণ করুন। সে সব দেশের বিপুলসংখ্যক সাহসী সংগ্রামী জনগণ তো ছিলেনই তা ছাড়া ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিলক, গোখেল, মতিলাল, জহরলাল প্রমুখ।

লেনিনের সঙ্গে ছিলেন স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, কামাল পাশার সঙ্গে আনোয়ার পাশা, মাও সেতুংয়ের সঙ্গে চৌন এন লাই ও চুতে, হোচি মিন ও ফিডেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গেও ছিলেন তার বিপস্নবী সাঙ্গীরা। তবু সমগ্র বিশ্বে এসব রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির পিতা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী, লেনিন, কামাল আতাতুর্ক, মাও সে তুং, হোচিমিন ও ফিডেল ক্যাস্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ ও অনেক সাহসী নিবেদিত চিত্ত বিপস্নবী নেতাকর্মী বিপুল অবদান রেখেছেন। তারা সবাই আমাদের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ও স্মরণীয়। এমনিভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম ও প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অনেক নেতাকর্মী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও সংগ্রামকে বেগবান করতে কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে সাহস যুগিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয় এক অবিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন প্রচেষ্টার এক সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার ফসল। এই প্রচেষ্টার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রয়েছে একটি গৌরবময় অধ্যায়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হচ্ছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের মধ্যে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসর্মথন লাভ করে। সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার ও সিপাহী অতি গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা কখনও সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কারণে এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়। শুরু হয় সরকারের গ্রেপ্তারি তৎপরতা। আইয়ুব সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেপ্তার করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে ঘোষণা করে যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ৮ জনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ পায়। এতে অভিযোগ করা হয় যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভু্যত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র দপ্তর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামি ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা বলে দাবি করেন। ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেফতার সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে উলেস্নখ করা হয় যে, গত মাসে (অর্থাৎ ডিসেম্বর, ১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই ষড়যন্ত্রকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' নামে অভিহিত করে। এই একই অভিযোগে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ৩৫ জনকে আসামি করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটিকে সরকারিভাবে নামকরণ করেছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যের বিচার। এই মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তারা হলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, আহমেদ ফজলুর রহমান, সিএসপি কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সাবেক এলএস সুলতানউদ্দীন আহমদ, এলএসসিডিআই নূর মোহাম্মদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজ উলস্নাহ, করপোরাল আবদুস সামাদ, সাবেক হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস, সিএসপি ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, বিভূতি ভূষণ চৌধুরী (ওরফে মানিক চৌধুরী), বিধান কৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, সাবেক কেরানি মুজিবুর রহমান, সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আব্দুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, এ বি খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান, সিএসপি, এ কে এম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এ এন এম নূরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মাহবুবু উদ্দীন চৌধুরী, লে. এম রহমান, সাবেক সুবেদার তাজুল ইসলাম, আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন এবং ল্যা. আবদুর রউফ।

মামলার অগ্রগতি এবং ট্রাইবু্যনালের প্রতিদিনের কার্যবিবরণী দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ায় মামলাটির ব্যাপারে জনমনে প্রচন্ড আলোড়ন জেগে উঠতে শুরু করে। মামলার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। বাইরের আন্দোলন আরো বেগবান ও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য রাজনৈতিক শক্তির ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মামলার প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি ১নং আসামি শেখ মুজিবুর রহমান তখন কাগমারীতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানীকে বাইরের আন্দোলনের নেতৃত্বদানের আহ্বান জানিয়ে অনুরোধ পাঠান। শেখ মুজিব জানতেন, জনবরেণ্য কোনো নেতা এই আন্দোলনে অগ্রগামী ভূমিকা না নিলে বাইরের আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে গণঅভু্যত্থানে পরিণত হবে না। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাদর্শী হলেও শেখ মুজিবকে পুত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন। সংবাদ পেয়ে মওলানা ভাসানী সেই সংবাদদাতার সম্মুখেই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠেন, শেখ মুজিব বলেছে। আমাকে যেতে হবে। সরকার এদের সবাইকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। পরদিন থেকে মওলানা ভাসানী ঢাকার রাজপথে। পল্টনের বিশাল জনসমুদ্রের সভায় উত্তাল মানুষগুলোকে তিনি অগ্নিময় কণ্ঠে আহ্বান জানালেন সরকারবিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে। আন্দোলনের খবর সরকারি ট্রাস্ট পত্রিকাগুলো বাদে দেশের সব পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ ফলাওভাবে প্রচারিত হতে শুরু করে। এ দিকে বাইরের আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার পক্ষ যেমন কম্পিত হয়ে উঠল ট্রাইবু্যনালের বিচারকদেরও মনোভাব পরিবর্তন হতে শুরু করেছে তা উপস্থিত সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ছিল কাঠগড়ায় পঁয়ত্রিশজন অভিযুক্তের সাহসী তেজী আর উৎফুলস্ন প্রকাশভঙ্গি। তারা কাগজে প্রকাশিত সব খবর না পেলেও আত্মীয়স্বজন, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং কখনো কখনো বন্দিদের প্রহরীদের কাছ থেকে গণআন্দোলনের তথ্য পাচ্ছিলেন। অভিযুক্তদের আইনজীবীরা হয়ে উঠলেন আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়। শেষের দিকে উৎফুলস্নচিত্তে দৃঢ় পদক্ষেপে ট্রাইবু্যনালে আসতেন। মামলা যে ভেস্তে যাবে সে সম্পর্কে তারা তখন অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তখন পূর্ব পাকিস্তানে তুঙ্গে। বছরের শেষ নাগাদ এবং ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা মাঠে নামেন। ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে পেশোয়ারের ছাত্রবিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশি হামলায় বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়। এই ঘটনাকে পুঁজি করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেন। এদিকে ১৯৬৮ সালে প্রথম দিকেই আইয়ুব খান একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রশাসনের ওপর তার বজ্রমুষ্ঠি শিথিল হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ এবং ক্ষমতার আশপাশে অবস্থানকারী উচ্চভিলাসিরা সামনে সুযোগের সম্ভাবনা দেখতে পান। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আইয়ুব খানকে জানানো হয় এবং আরও জানানো হয় যে, সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারের সুযোগ তার জন্য আর খোলা নেই। অতএব, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানো ছাড়া আইয়ুবের উপায় থাকল না। আর সেই সুযোগ তিনি কেবল পেতে পারেন শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে। কারণ শেখ মুজিব ছাড়া দেশের পূর্বাঞ্চলকে আলোচনা টেবিলে আনার চেষ্টা হবে সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক। এই বেসামাল পরিস্থিতিতে আইয়ুব খান সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় আর এক অভাবনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। হাজার হাজার উলস্নসিত বিজয়ী বাঙালি ক্যান্টনমেন্টে জমায়েত হতে থাকে বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যেতে। নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির কারণে সেদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯ আর শেখ মুজিবকে মুক্তি করা হলো না। ক্যান্টনমেন্ট উদ্বেল মানুষের ঢল কিছুটা কমে আসলে পর দিন ২২ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯ শেখ মুজিব ''মুক্ত মানুষ" হিসেবে বাইরে এলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হলো। সব অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হলো এবং শেখ মুজিব বাঙালি জাতির মহানায়ক এবং পূর্ব বাংলার গণমানুষের আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।

গত ২৭ জুন বৃহস্পতিবার ২০১৯ইং তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারের বিষয়বস্তু- 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিবৃত্ত ও বঙ্গবন্ধু'। সেমিনারে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন এডভোকেট সাহিদা বেগম ও সহকারী এটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ হাইকোর্ট। উপস্থাপিত বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অনেকেই। অংশগ্রহণকারীরা একজন প্রবন্ধ উপস্থাপনকারীকে আন্দোলন সংগঠন পরিষদের জনৈক আমীর আলী কর্তৃক তাদের পরিষদের কার্যক্রম বিষয়ে তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। উত্তরে সাহিদা বেগম আমীর আলী সম্পর্কে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, তিনি প্রায়শই পরিষদের টাকা পয়সা তহবিল এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে বিরুদ্ধে পক্ষ অবলম্বন করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি সরকারের পক্ষ হয়ে অনেক সময় গুপ্তচর বৃত্তির কাজেও সহায়তা করতেন। প্রাবন্ধিক অবশ্য তার লিখিত প্রবন্ধে তিনি এরকম লিখেছেন যে, বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দোলার পতনে মীর জাফর আলী খানদের মতো লোকেরা যেমন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রসহ কূটচালের ভূমিকা পালন করেছেন। তেমনি মীর মদন, মোহন লালদের মতো তদীয় ব্যক্তিগণের ব্যক্তিত্ত্ব ও সাহসিকতার ঝান্ডাও উড়িয়েছিলেন। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একজন বক্তার প্রশ্ন ছিল এরকম যেমন- সেসময়কার মীর জাফর আলীর প্রেতাত্মারা এখনো এই দেশে এই সময়ে বিচরণ করছে। তাদের ছোবলে ও ষড়যন্ত্রের ফলে জাতির পিতা তার পরিবারসহ এক মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে ছিলেন। জাতির পিতার মতো অসীম সাহসী নেতার যদি এমন পরিস্থিতির বলি হতে হয় সে ক্ষেত্রে তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কতটা সম্ভব হবে? প্রশ্নের সহজ ও সাবলীল উত্তর হচ্ছে ত্যাগ, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা। কিন্তু এই সহজ ও সাবলীল উত্তরটিকে গুড়িয়ে পেঁচিয়ে তালগুল পাকিয়ে ফেলেন অনেকেই। যাই হোক- এই সেমিনারে মামলার আসামিদের অনেক যোগ্য উত্তরসূরি এমনকি খোদ আসামি জলিল সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। তারা তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বর্তমান সরকারের কাছে যথাযথ মর্যাদা প্রদানের বিষয়ে দাবি উত্থাপন করে থাকেন। তারা বলতে চাচ্ছিলেন যে, এই সাহসী লোকগণ তৎকালীন অনেক জেল জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সাহসিকতার যথাযথ মূল্যায়ন তাদের ভাগ্যে জুটেনি। আলোচকদের একজন হিসেবে আমার বা দেশবাসীর অনেকেরই জানা আছে যে,

সাবেক ইকবাল হলটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহিরুল হক সাহেবের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তবে এই সাহসী মানুষদের মূল্যায়নের পক্ষে আমিও। রাষ্ট্র তাদের সেভাবে মূল্য দিলে জাতির কোনো কমতি বা ঘাটতি হবে না। কাজেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই মামলার সাহসী সন্তানদের- যারা মৃতুু্যবরণ করেছেন বা করেননি তাদের জাতীয়ভাবে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মান দিয়ে জাতি তার দায় মুক্তির ব্যবস্থা নিতে পারে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<60656 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1