শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
হ্যালো লিডার হ্যালো মিনিস্টার

চিকিৎসাব্যবস্থায় সার্বজনীন আস্থা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে করণীয়

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারের জায়গাটিতে যখন ভালোবাসার চেয়ে ব্যবসা গুরুত্ব পায় তখন মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষের আস্থাহীনতায় ক্ষোভের স্তর ভারী হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে তার সবই কেটে যাবে বলে আশা করা যায়। শুধু সরকারি কর্মচারী হাসপাতালই নয়, দেশের সব হাসপাতালে এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজে এগিয়ে নেয়া উচিত।
সোহেল হায়দার চৌধুরী
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সম্প্রতি চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, দেশের মানুষেরও এই বিরক্তি কমবেশি রয়েছে। সব চিকিৎসককে নিয়ে এই বিরক্তি প্রকাশ করা না গেলেও অনেক চিকিৎসক পেশা ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা পেশার মহত্ত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন নিজের মহানুভবতা দিয়ে। আবার অনেকেই রয়েছেন, পেশাকে বাণিজ্যিক করে, অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে, নগ্ন দলবাজির মাধ্যমে নিজের আর্থিক উন্নতিই শুধু ঘটাচ্ছেন না, একই সঙ্গে পেশার মর্যাদা নষ্ট করছেন এবং করছেন শপথ ভঙ্গ। এদের অনেকে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আবার অনেকে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে জাতিকে জ্ঞান দান করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সবই জানেন। চিকিৎসাব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংকটগুলো তিনি একাধিকবার তুলে ধরেছেন। চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও সেবার ধরন কেমন হওয়া উচিত তাও উলেস্নখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সরকারি হাসপাতালগুলোকে খোলামেলা রাখা, রোগীদের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাওয়ার মতো করে অবকাঠামো নির্মাণ এবং হাসপাতালেই চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছেন কয়েক মাস আগে। এই নির্দেশনা প্রমাণ করে দেশের মানুষের প্রতি তার সীমাহীন দরদের কথা। প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করলেন, মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে তার সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। তার সে আন্তরিকতার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন তিনি হাসপাতালে ডে-কেয়ার সেন্টার রাখা, রোগের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা বস্নক তৈরির নির্দেশনা দেন। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ধরনের নির্দেশনা 'জনবান্ধব চিকিৎসাব্যবস্থা' গড়ে তোলার পূর্বশর্ত বলে বিবেচনা করা যায়। এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় থাকা আস্থার সংকট অনেকটাই কমে আসবে সেটা নিশ্চিত।

গত ১২ মার্চ মঙ্গলবার একনেক সভায় 'সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ' শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'সরকারি হাসপাতালেই যাতে চিকিৎসকরা একটা উইং (শাখা) নিয়ে বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন সেভাবেই হাসপাতালের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। চিকিৎসক ও রোগীরা বাইরে বাইরে দৌড়ায়। এখানেই (হাসপাতালে) তাদের একটা সুন্দর জায়গা দিয়ে দেন। এখানেই তারা (চিকিৎসক) প্র্যাকটিস করুক। যাতে তাদের বাইরে যেতে না হয় এবং রোগীরাও সরকারি হাসপাতালেই সেবা পান।' প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে রোগী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে।

দেশের চিকিৎসা খাত নিয়ে জনগণের মধ্যে কমবেশি আস্থার সংকট এবং ক্ষোভ রয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা বা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই প্রতিবছর লাখো মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা করতে যান। এটি কখনোই বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়।

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারের জায়গাটিতে যখন ভালোবাসার চেয়ে ব্যবসা গুরুত্ব পায় তখন মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষের আস্থাহীনতায় ক্ষোভের স্তর ভারী হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে তার সবই কেটে যাবে বলে আশা করা যায়। শুধু সরকারি কর্মচারী হাসপাতালই নয়, দেশের সব হাসপাতালে এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজে এগিয়ে নেয়া উচিত।

বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসক, সেবক এবং প্রচুর উন্নত যন্ত্রপাতি রয়েছে। কিন্তু রোগীর প্রতি একশ্রেণির চিকিৎসকের মনোযোগের অভাব ও ব্যবসায়িক মানসিকতা, সেবকদের একটি অংশের যথাযথ সহযোগিতার মনোভাবে ঘাটতি, রোগ নির্ণয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা, পরীক্ষার দর সব স্থানে একরকম না হওয়ায় মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এসেছে ঠিকই, কিন্তু একশ্রেণির চিকিৎসক বা সেবক-সেবিকাদের অমনোযোগিতার বিষয়টি আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো সরকারি হাসপাতালের বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক পূর্ণ সময়জুড়ে তার কাজটি করেন না। সেবক-সেবিকাদের আন্তরিকতার ঘাটতি এখনো বহাল রয়েছে। অথচ মানুষের জীবন রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করার অঙ্গীকার নিয়ে এ পেশায় আসতে হয় তাদের।

এই পরিস্থিতিতে জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থায় যে গুণগত পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছেন তার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। চিকিৎসা খাতকে নিয়মের মধ্যে আনতে অনেক আইন, বিধি বা নিয়ম-কানুন রয়েছে। সেগুলোর খুব বেশি ফল যে পাওয়া গেছে তা নয়। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এখন দেখার বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কতটা আন্তরিকভাবে কাজটি করে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখা যেতে পারে-

১। দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আলাদা একতলা বা বহুতল ভবন করে ডক্টরস চেম্বার তৈরি করা। যাতে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার কর্মস্থলেই একটি নির্দিষ্ট সময় উপযুক্ত ভিজিট নিয়ে রোগী দেখতে পারেন।

২। চিকিৎসকদের রোগী দেখার একটি পরিমাণ ও ফি নির্ধারণ দেয়া যেতে পারে। যা দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক হতে পারে। প্রয়োজনে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কিছু কমবেশি হতে পারে, তবে সেটা যাতে মাত্রাতিরিক্ত না হয় তা মনিটর করতে হবে। ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান, মূল্যস্ফীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আমলে রাখতে হবে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি বাড়ানো যেতে পারে।

৩। বিশেষজ্ঞ চিকিসকদের প্রতি সপ্তাহে তার সুবিধামতো সময়ে গ্রামাঞ্চলে রোগী দেখার বিশেষ ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে।

৪। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর গ্রেডিং বা মান নির্ধারণ করে দেয়া অতি প্রয়োজনীয়। পরীক্ষা-নীরিক্ষার ক্ষেত্রে একই ধরনের পরীক্ষার দর সব ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে একই হারে হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা।

৫। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর গ্রেডিং বা মান নির্ধারণ করে দেয়া। সমপর্যায় বা সমমানের সব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে বেড, রুম, আইসিইউ, সিসিইউর দর একইরকম হওয়া প্রয়োজন।

৬। প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সবধরনের ফ্রি বেড বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সেটি যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা।

৭। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর জন্য একটি নির্দিষ্ট ফরম তৈরি করা যেতে পারে। যাতে রোগী বা তার অ্যাটেনডেন্ট স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবেন। এতে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের সময় বাঁচবে।

৮। চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা, হাসপাতাল-ক্লিনিক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পুরস্কার বা পদক চালু করা। যার নাম হতে পারে 'বঙ্গবন্ধু চিকিৎসাসেবা পদক'। প্রতি বছর সেরা চিকিৎসক, সেরা সেবক-সেবিকা, সেরা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ পদক দেয়া যেতে পারে।

চিকিৎসাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের একাংশ বরাবরই সচেষ্ট। কিন্তু সংকট কাটছে না। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থার সংকট থেকেই যাচ্ছে। কোনো রোগী যখন চিকিৎসকের মুখোমুখি হন, তখন তিনি চান চিকিৎসক তার বিস্তারিত বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সেবক বা সেবিকা তার যত্নটি যথাযথভাবে নিক। কিন্তু সব চিকিৎসক বা সেবকের কাছে সেটি পান না রোগীরা। ফলে হতাশা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে নয় দেশে চিকিৎসা নেয়ার কথা বলেছেন। তিনি দশ টাকা দিয়ে টিকেট কিনে তার চিকিৎসা করিয়েছেন। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আস্থার সংকট কাটাতে বা আরও প্রগাঢ় আস্থা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবন দান করেন, আর চিকিৎসকরা জীবন রক্ষা করেন। সে কারণে চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। এটিকে সেবা বলেও বিবেচনা করা হয়। সেই সেবা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের সবাই চিরপূজনীয় করে রাখতে চায়। সেজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ত্যাগ করা এবং আচরণে গুণগত পরিবর্তন আনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাকে বাস্তবে রূপ দিতে চিকিৎসক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশে প্রকৃতঅর্থে 'গণমুখী চিকিৎসাব্যবস্থা' গড়ে তোলা দুরূহ নয়। সেজন্য প্রথমত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সৎ, একনিষ্ঠ এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও চিকিৎসক সমাজের ঐকান্তিক আগ্রহ।

সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (ড্যাব) সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দলীয় বৃত্তের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও মানুষের কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে এসে চিকিৎসাব্যবস্থায় থাকা গলদ ও সংকট দূর করতে হবে।

সোহেল হায়দার চৌধুরী: বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66129 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1