শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, সীমান্ত হত্যা, মাদক ও অবৈধ চোরাকারবারিসহ অনেক ধরনের দ্বিপক্ষীয় বিষয় থাকলেও পানির সমস্যা সব সময় বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। পানির সঙ্গে আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত। আর আমাদের ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫১টিই ভারত থেকে এসেছে। ভারত প্রতিটি নদীতেই কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থে পানি ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিএম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অব.)
  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তিনদিনের (১৯-২১ আগস্ট) বাংলাদেশ সফর শেষ করলেন। শুরুতে স্পষ্ট করে কিছু না বলা হলেও তার আসার হয়তো নানাবিধ উদ্দেশ্য ছিল। প্রাথমিকভাবে আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর ৩ ও ৪) ভারতের অর্থনৈতিক সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীর যোগদানের প্রস্তুতির সমন্বয়/পর্যালোচনা এবং তাকে একটি দ্বিপক্ষীয় সফর হিসেবে পরিণত করা। দ্বিতীয়ত কাশ্মীরসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা। উলেস্নখ্য যে সফরের দ্বিতীয় দিন তিনি প্রথমে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা এবং বিকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কিছু বার্তা পৌঁছে দেন। দুই মন্ত্রী একটা যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনেও তাদের বক্তব্য প্রদান করেন। উলেস্নখ্য, জয়শঙ্কর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর খুব বিশ্বস্ত এবং কাছের একজন মানুষ। অতএব তার ভ্রমণ, চিন্তা-চেতনা এবং বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে আমরা বলতে পারি যে তার এই ভ্রমণ খুবই সফল হয়েছে।

প্রথমে আসা যাক বিনিয়োগ সম্মেলন ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে। যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনে সম্মত হয়েছে। সেক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক সম্মেলনের পরের দিন অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ০৫ তারিখে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকটি হবে। তাহলে এটি হবে এপ্রিল ২০১৭ সালের পর দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আর একটি বৈঠক। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক সংস্কৃতি, পাট, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় ভারতীয় বিনিয়োগ, খুলনা ও মোংলা এসওপি (ট্রানজিট সংক্রান্ত) ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ১৫ থেকে ১৬টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আলোচনার সময় রোহিঙ্গা সমস্যা, কাশ্মীর ইসু্য, আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও পানি সমস্যাসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা হতে পারে।

রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ না করেও ভারতীয় মন্ত্রী তাদের নিরাপদ, দ্রম্নত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বক্তব্য ও চাহিদাও তাই। অর্থাৎ যদিও বাংলাদেশই রোহিঙ্গা সমস্যার সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করছে কিন্তু তার সমাধান ও প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে এখন ভারত বাংলাদেশের পার্শ্বে আছে। তার এই বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে ভারত ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে বাংলাদেশের নয় বরং মিয়ানমারের পক্ষে থাকার কথা বলেছিল। উলেস্নখযাগ্যে যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য চীন ও ভারতের সমর্থন, সহযোগিতা এবং প্রভাব একান্ত দরকার যা শুরুতে বাংলাদেশের ছিল না। মিয়ানমারের হাজারও টালবাহানার মধ্যেই বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের সমর্থনে ও মধ্যস্থতায় (অপ্রত্যক্ষ) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি করেছে। এখন ভারত যদি তার কথামতো কাজ করে তবে বাংলাদেশের তথা এ অঞ্চলের একটা বড় বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান হবে। উলেস্নখ্য, ভারত রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারকে প্রায় ৩০০/৪০০ বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। এবং নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অন্যসব রোহিঙ্গা ফেরত যেতে না চাইলেও শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় সমপরিমাণ সনাতন ধর্মাবলম্বী লোক কোনোরূপ শর্ত ছাড়াই মিয়ানমারে ফেরত যেতে ইচ্ছুক।

সম্প্রতি ভারত সরকার কর্তৃক সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং কাশ্মীরকে ভেঙে জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটা অঞ্চলে বিভক্ত করার ফলে কাশ্মীর ইসু্যটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এই ইসু্যতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারত তাদের সব শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে নেমেছে। চীন ও পাকিস্তানের প্রচেষ্টায় বিষয়টির ওপর দীর্ঘ ৪৯ বছর পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। বিষয়টি আগামী মাসে প্রস্তাবিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও উঠতে পারে। তাই কাশ্মীর ইসু্যতে উভয় দেশেরই বিশেষ করে ভারতের জোর আন্তর্জাতিক সমর্থন দরকার। তাই কাশ্মীর যে এই সফরে আলোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ভারতীয় মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি। অন্যদিকে বিকালে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তাদের আলোচনায় কাশ্মীর প্রসঙ্গটি আসেনি। তবে জয়শঙ্কর ঢাকা ছাড়ার আগেই (আগস্ট ১৯, ২০১৯ সকালে) সব জল্পনা-কল্পনার অবকাশ ঘটিয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে ৩৭০ ধারা রদ ও কাশ্মীর ইসু্য ভারতের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অনেক জনসাধারণের মতামত উপেক্ষা করে আমাদের এই অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের জন্য একটি বড় উপহারই বটে। এখন ভারত আমাদের কি দেয় তা কিন্তু দেখে হবে। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের বিভাজনের মধ্যে সৌদি লাইনকে সমর্থন দেয়ার বাংলাদেশের যে নীতি আমরা দীর্ঘদিন দেখে আসছি তার ধারাবাহিকতায় দেশের বৈশ্বিক স্বার্থে কাশ্মীর ইসু্যতে আমরা ভারতের পক্ষে থাকতেই পারি।

ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, সীমান্ত হত্যা, মাদক ও অবৈধ চোরাকারবারিসহ অনেক ধরনের দ্বিপক্ষীয় বিষয় থাকলেও পানির সমস্যা সব সময় বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। পানির সঙ্গে আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত। আর আমাদের ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫১টিই ভারত থেকে এসেছে। ভারত প্রতিটি নদীতেই কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থে পানি ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।

\হপদ্মার পানি বণ্টনের একটা চুক্তি হলেও ভারত বাস্তবে তা পালন করে না। তারা পশ্চিম বাংলার অসম্মতির কথা বলে তিস্তা চুক্তিও দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছে। আগের সব আলাপ-আলাচেনা বাদ দিয়ে কোনো এক অজানা কারণে ভারত সম্প্রতি মনু, ধরলা, খোয়াই, গোমতি, মহুরি, ফেনী ও দুধকুমার এই সাতটি নদীর পানি বণ্টনের প্রতি জোর দিয়েছে। পাশাপাশি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পানি বণ্টনের নতুন উপায় খোঁজার কথা বলেছেন। তা যদি হয় তবে সমগ্র বিষয়টি আবার একটি দীর্ঘমেয়াদি কালক্ষেপণের মধ্যে পড়ে যাবে।

এছাড়া আসামের এনএসসি, সীমান্ত বেড়া, সীমান্ত হত্যা, সমুদ্রের মহীসোপান, জলবিদু্যৎ, জ্বালানি, বন্দর ব্যবহার, ঋণচুক্তিতে প্রদত্ত অর্থে ভারত থেকে অত্রসহ সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আরও অনেক ইসু্য নিয়েই হয়তো আলোচনা হয়েছে। পানির ন্যায় বণ্টন ও রোহিঙ্গা ইসু্যতে। ভারতের অবস্থানের পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা যা একটা মানবিক সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অস্ত্র ক্রয় যা বাস্তবতার আলোকে অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনেক তীর্যক কথা বলার সুযোগ আছে। তারপরেও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ভালো সম্পর্কে থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই বন্ধুপ্রতিম আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান এসব সমস্যার ন্যায্য সমাধান হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নবাদীদের সব ধরনের আশ্রয় বন্দ করা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান ও এককভাবে ট্রানজিট সুবিধা দেয়াসহ ভারতের স্বার্থে ইতোমধ্যে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক পিছিয়ে আছে। তাছাড়া চুক্তি করা বা কথা দেয়ার পরেও তা মেনে চলা কিম্বা কার্যকর করার ব্যাপার তাদের। রেকর্ড ভালো নয়। এ প্রসঙ্গে পদ্মার পানি বণ্টন, ছিটমহল হস্তান্তর, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদিকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। বিষয়টি কিন্তু এখন ভারতীয় বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীও স্বীকার করে। তাই আমার মনে হয় একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের উচিত বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়াকে আরও বেশি সহনশীলতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা। তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় আমাদের প্রধান চাওয়া হবে অবশ্যই তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন (হিস্যা পাওয়া) ও জলবিদু্যৎ উৎপাদনসহ এ অঞ্চলের পানি সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আমরা আর সীমান্ত হত্যা দেখতে চাই না।

পাশাপাশি এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, জনগোষ্ঠী আর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও ভারতের একই রকম মনোভাব দেখানো উচিত। ভারতকে আমাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যার আবাসস্থল দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ ও সব মানুষের স্বার্থে আমরা ভারতের কাছে তা কি আশা করতে পারি না? আমাদের কারও একক জয় নয় বরং আমাদের সবার জয় চাই।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিএম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অব): কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

য়ঁধসৎঁষথমস@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66429 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1