শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনার শেষ নেই কেন?

ঢাকায় ইদানীং অদক্ষ বাসচালকদের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। চালকদের অদক্ষতার কারণে রাজপথে অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। মৃতু্য থেকে শুরু করে হাত-পা হারানো, মারাত্মকভাবে আহতের ঘটনা মানুষকে ক্রমশ ভয়ার্ত করে তুলেছে। মানুষের জীবন নাশের কারণে বাসচালক ও হেলপারদের কতটুকু শাস্তি পেতে হয়েছে- তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। জীবনের মূল্য কি শুধু কয়েক লাখ টাকা? বাসচালকদের কঠিন শাস্তি নয়?
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের মানুষের জীবনের ওপর একটার পর একটা অশান্তির কোলো ছায়া প্রভাব বিস্তার করছে, ভীতি আর দুর্ভাবনা ক্রমশই বাড়িয়ে তুলছে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের ওপর ফরমালিন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গুপ্তহত্যা, ডেঙ্গু, নিরুদ্দেশের সঙ্গে সড়[ক দুর্ঘটনায় মানুষের অকাল মৃতু্য যেন কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

\হসড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন আলোচনা হয়েছে, মিটিং ও সেমিনারেও কম আলোচনা হয়নি। আলোচনা যেন আলোচনার মধ্যেই থেকে গেছে, কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। ঢাকার রাজপথে দু'ধরনের ঘটনা জনসাধারণকে ক্রমাগত চিন্তিত করে তুলেছে। প্রথমটি হলো ট্রাফিক জ্যাম এবং তা নিয়ন্ত্রণের অভাব আর দ্বিতীয়টি বলা যায় বাসের চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষের মৃতু্য। এক সময় রাস্তায় দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্যর পর তাদের ঢাকার রাস্তায় নেমে এসে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ঘটনা এ দেশের মানুষ ভোলেনি, ভালো একটা দৃষ্টান্ত মানুষের স্মৃতিতে আজো জমা হয়ে আছে।

ঢাকার রাস্তায় যানজট নতুন নয়। ইদানীং কিছু রাস্তার বিস্তৃতি খানিকটা ছোট হয়ে গেছে রাস্তার ওপরে ট্রেন লাইন নির্মাণের কারণে। এ দিক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। কারণ, ভালো একটা কাজের কারণে রাস্তার বিস্তৃতি কমে যাওয়া স্বাভাবিক। রাস্তা ছোট হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ঢাকা শহর যেভাবে গড়ে উঠেছে সেখানে নতুন কিছু নির্মাণ করতে গেলে সাময়িক অসুবিধে হবেই। কলকাতায় পাতাল রেল রাস্তার নিচে তৈরি করা হয়েছিল বলে জনসাধারণের খানিকটা অসুবিধে যে হয়নি- তা নয়; তবে তেমন ব্যাপক আকারে নয়। ব্যাংককের বিভিন্ন দিকে জনবসতি গড়ে ওঠার আগেই রাস্তার ওপরে রেললাইন নির্মাণ করা হয়। ভারতে নতুন দিলিস্ন তৈরির সময়ই রাস্তার চারপাশে গাছ বুনে সবুজের সমারোহ তৈরি করা হয়। এই কারণে পুরনো দিলিস্নর প্রকৃতির সঙ্গে নতুন দিলিস্নর প্রকৃতির অনেক পার্থক্য।

ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের একাধিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, একই রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, রিকশা, সিনজি চলাচল করায় একই গতিতে সব গাড়ি চলাচলে অক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে রাস্তায় মোটরসাইকেল নেমেছে, যার চালক সব সময় নিয়ম-কানুন মেনে গাড়ি চালান না। ঢাকার রাস্তার অনুপাতে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি।

দ্বিতীয় একটা কারণ, যা প্রধান কারণের পর্যায়ে ফেলা যায়। গাড়িচালকরা সব সময় নিয়ম-কানুন মেনে চলেন না এবং এটা সাধারণ একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটারের রাস্তার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলেই এই সাধারণ দৃশ্য চোখে পড়বে। এখানে বাঁ দিকের রাস্তার গাড়ি ঘুরে বাঁ দিকে যাওয়ার সময়গাড়ি চালককের কোনো অসুবিধে হয় না, কিন্তু এই রাস্তার ডানদিক থেকে ডানদিকে ইউটার্ন নেয়ার সময় অসংখ্য গাড়ি আগে যাওয়ার কারণে নিয়ম ভেঙে বাঁ দিকের রাস্তার একটা বড় অংশ অধিকার করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তৃতীয়, রাস্তায় চলমান যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক সরকারি ও বেসরকারি বাস। আগে বিআরটিসির একটা সুনাম ছিল দক্ষ বাসচালক ও নিরাপদে গাড়ি চালানোর জন্য। এখন সে রামও নেই আর অযোধ্যাও নেই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ হলো প্রাইভেট বাস ও তার চালক। ঢাকার বাস সম্পর্কে আগে একাধিক অভিযোগ উঠলেও তার প্রকৃত সমাধান হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন না। ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত বাস সম্পর্কে যে দিকগুলো কঠিনভাবে পর্যালোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন, সেগুলো হলো: বাসের ফিটনেস, ঠিকমত লাইসেন্স আছে কি না, বাসচালকদের লাইসেন্স ও গাড়ি চালানোর যোগ্যতা। ঢাকার রাস্তায় বাসচালকদের কাছে নিয়মের কোনো বালাই নেই। রাজপথে তারাই রাজা, আর সবাই তাদের প্রজা। বাসচালকরা কোনো নিয়ম মানে না এবং সুযোগ পেলেই বিভিন্ন লেন ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। অনবরত লেন পরিবর্তন করার কারণে অন্যান্য গাড়ি চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। শুধু কোনো রাস্তার মোড় এলে ট্র্যাফিক পুলিশ কর্তব্যরত অবস্থায় থাকার কারণে নিজেদের লেনে এসে একটু পরেই আবার লেন পরিবর্তন করে।

বাসচালকদের অনবরত লেন পরিবর্তনের প্রধান কারণ নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই শ্রেণির প্রতিযোগিতা আরো করুন আকার ধারণ করে রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের তোলা ও নামানো। এই অনিম যে দূর করা যায় না- তা নয়। এর কারণ যাত্রী নির্দিষ্ট স্থানে তোলা ও নামানোর জন্য বাসস্টপেজ করা প্রয়োজন এবং স্টপেজে পৌঁছানোর আগে যাত্রী তোলা ও নামানোর ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা। ঢাকায় যে বাসস্টপেজ নেই, তা নয়। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় যাত্রী তোলা ও নামানোর জন্য হাতেগোনা স্টপেজ বাসের এই অনিয়ম দূর করার জন্য প্রয়োজন ভ্রাম্যমাণ ট্র্যাফিক পুলিশ। বাসের অনিয়ম দেখলেই তাদের সতর্ক করে প্রথম টিকেট দেয়া এবং একাধিকবার ঘটনার অনিয়ম করলেই দ্বিতীয়বার টিকেট দিয়ে জরিমানা করা অথবা মামলা করা। আরো একটা দিকে সর্তক দৃষ্টি করা প্রয়োজন- বাসচালকদের একই ধরনের পোশাক জরুরি এবং বাস চালানো সময় মোবাইল ব্যবহার করা ও ধূমপান করার ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান।

ঢাকায় ইদানীং অদক্ষ বাসচালকদের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। চালকদের অদক্ষতার কারণে রাজপথে অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। মৃতু্য থেকে শুরু করে হাত-পা হারানো, মারাত্মকভাবে আহতের ঘটনা মানুষকে ক্রমশ ভয়ার্ত করে তুলেছে। মানুষের জীবন নাশের কারণে বাসচালক ও হেলপারদের কতটুকু শাস্তি পেতে হয়েছে- তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। জীবনের মূল্য কি শুধু কয়েক লাখ টাকা? বাসচালকদের কঠিন শাস্তি নয়?

ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশ শক্ত হাতে কেন অনিয়ম বন্ধ করতে পারেন না তাও সবার জানা নেই। কারণ ট্র্যাফিক পুলিশদের চোখের সামনেই গাড়ি চলাচলে অনিয়ম দেখা গেলেও পুলিশ বোধ হয় সেগুলো এড়িয়ে চলেন।

\হসম্ভবত, অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে যতজন ট্র্যাফিক পুলিশের প্রয়োজন তার অভাব এবং সারাদিন হাত নাড়তে নাড়তে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আর রাস্তায় ট্র্যাফিক লাইটতো কোনো কাজেই আসে না। এ ক্ষেত্রে ট্যাফিক পুলিশ নয়, দায়ী গাড়িচালকরা। তাদের কাছে লাল, সবুজ লাইট অর্থহীন তাড়াতাড়ি সামনে যাওয়াই যেন বড় দায়িত্ব। এই দিকটি পর্যালোচনা করে একটা কথাই বলতে হয়। এ দেশের মানুষের মধ্যে কর্তব্যবোধ দায়িত্ব ও আদর্শ বলে কোনো শব্দ নেই।

রাস্তার উপর ট্রেন লাইন নির্মাণ শেষ হলে জনসাধারণ এর রাস্তা ব্যবহার কিছুটা হ্রাস হতে পারে। তার ফলে বাসের সংখ্যা সামান্য কমলেও অন্যান্য যানবাহনের ব্যবহার বোধ হয় আগে মতোই থাকবে। বাংলাদেশের আশপাশের দেশ। যেমন কলকাতার পাতাল রেল, ব্যাংককের রাস্তার ওপর ট্রেন, এমনকি লন্ডনে পাতাল রেল লক্ষ্য করলে ওপরের মন্তব্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঢাকার রাজপথ খানিকটা হালকা করার জন্য প্রয়োজন ঢাকার আশপাশে উপশহর নির্মাণ, সরকারি ও বেসরকারি কিছু অফিস উপশহরে এবং দুয়েকটা বড় শহরে স্থানান্তর। তবে, এসবতো ভবিষ্যৎ বা পরিকল্পনার ব্যাপার। ঢাকা শহরে রাস্তায় যানজট নিরসন ও গাড়ির নিচে নির্মমভাবে মানুষের জীবনক্ষয় বন্ধ করার ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে ঔচিত্যবোধ ও বিবেক না থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকার অনেক রাস্তার আয়তন বর্তমানে কমে গেছে রাস্তায় উপর ট্রেনের নির্মাণকাজ করার কারণে। এসব রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় বেশির ভাগ গাড়িচালকই সতর্কভাবে গাড়ি চালান কিন্তু এখানেও বাসের দৌরাত্ম্য যে হ্রাস পেয়েছে, তা নয়। অনেক দেশেই বিপজ্জনক রাস্তায় বা সেখানে দুর্ঘটনা ঘটনার সম্ভাব্য থাকে। সেখানে বড় বড় সাইনবোর্ডে সতর্কবাণী থাকে। এটা দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, সতর্কভাবে গাড়ি চালান। ঢাকার রাস্তায়ও যদি কোনো কোনো অংশে এই ধরনের সতর্কবাণী লেখা হয় এবং তারপরও কোনো গাড়িচালক তা অমান্য করে তাহলে শাস্তি প্রদান করে অসতর্কভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ করা যায় কি না তা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

রাস্তা বা ফুটপাতে চলাচল মানুষের অধিকার সেখানে অধিকার হরণ করে তাদের ওপর বাস চালিয়ে মৃতু্য আচরণ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন নির্মম শাস্তি।

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66563 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1