শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষের করুণ অবস্থা। তারা এখন আর পেঁয়াজ খেতে পারছে না। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারই পেঁয়াজ খাওয়া বাদ দিয়েছে। কিন্তু এটা কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের নৈরাজ্য আর কতদিন চলবে। এমন অরাজক পরিস্থিতির দ্রম্নত অবসান জরুরি।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

পেঁয়াজ নিয়ে হচ্ছেটা কী? এই প্রশ্ন এখন ভোক্তাদের মনে। তারা ক্ষুব্ধ, হতাশ, দিশাহারা। বিমানে করে পেঁয়াজ আনার পরও দাম কমছে না। উপরন্তু কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। বিমানে করে পেঁয়াজ আনার পর কয়েকদিন দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। দেশি পেঁয়াজ তখন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হতো। দিন সাতেক যেতেই অসাধু ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন খুচরা বাজারে ভালো মানের প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। আর আমদানি করা মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। চিন মিশর থেকে আসা বড় ঝাঁজহীন পেঁয়াজের দাম তুলনামূলকভাবে কম হলেও ক্রেতাচাহিদা নেই বললেই চলে। এই পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। বাধ্য হয়ে মানুষ ওই পেঁয়াজ খাচ্ছে। এক বছরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪২৩ %, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। বাণিজ্যমন্ত্রীর নানা আশ্বাস কোনো কাজেই আসছে না। বরং তার এক অর্বাচীন মন্তব্য (মানুষ বিমানে চড়তে পারে না। আর পেঁয়াজ এসেছে বিমানে করে) বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। পেঁয়াজের দাম কমে ১৫০ টাকার আশপাশে নামার পর আবার অগের দামে ফিরে যাওয়া কোনো ভালো রক্ষণ নয়। এতে খুব সহজেই বোঝা যায় বন্ধ হয়নি পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য ও অরাজকতা।

\হভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর দুই মাস ধরে দাম বাড়তে বাড়তে দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতিকেজি ২৫০ টাকায় পৌঁছেছিল। সেই সঙ্গে মিয়ানমার, মিশর, চীন ও তুরস্কের পেঁয়াজের দামও বেড়েছিল পালস্না দিয়ে। এরপর ফরিদপুর, পাবনা, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলার বাজারে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ ওঠার পাশাপাশি কার্গো বিমানে করে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ঘোষণায় দাম কমতে থাকে। এরমধ্যে নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবিতে বুধবার পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের দিন থেকেই পেঁয়াজের দাম আবার বাড়তে থাকে। সেই বাড়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম সব রেকর্ড ভেঙেছে। তাই ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ কিনতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। দীর্ঘলাইনে অপেক্ষা করে ৪৫ টাকায় কিনছেন টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পেঁয়াজ। রাজধানীতে পেঁয়াজ কিনতে মানুষের লম্বা সারি চোখে পড়ছে। প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালে মিলছে পেঁয়াজ। দেশের কোথাও কোথাও পুলিশ পাহারায় টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হয়ে মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়িয়েছে। তবে পেঁয়াজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্রেতারা। বাজারে পেঁয়াজের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে তারপরেও দাম বাডিয়ে দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য এখনো কেন বন্ধ হয়নি এটা এখন দেশবাসীর জিজ্ঞাসা। এই যে পেঁয়াজ নৈরাজ্য অরাজকতা, এটা দেখার যেন কেউ নেই। সরকারের নানা পদক্ষেপেও কাজ হচ্ছে না কেন। সরকারের প্রতিপক্ষ সমালোচক যারা তারা বলছেন, কারসাজিকারীরা সরকারের লোক। এটা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়ে থাকে এই অভিযোগ খন্ডনের দায়িত্ব সরকারের। আজ চাল, পেঁয়াজ, চিনি, লবণ নিয়ে অরাজকতা হচ্ছে কাল যে অন্য পণ্য নিয়ে হবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? বলা হয়ে থাকে সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। এই কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে সরকারকেই।

এ ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটলেও সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস বাড়ছেই। ৪০ টাকার পেঁয়াজ কী করে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এবং এখন আবার ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা আবশ্যক। বাণিজ্যমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন অক্টোবর মাসের শেষে দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন নতুন পেঁয়াজ আসার আগ পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার নিচে নামবে না। অথচ বিমানে আমদানি করার পরও ক্রেতাদের প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) উদ্যোগ বাজারে কোনো প্রভাব ফেলেনি। অভিযোগ রয়েছে টিসিবির পেঁয়াজ কালো বাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না।

বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পেঁয়াজ চাষের জন্য চাষিদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হবে। তখন আর বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি, আমদানিকৃত পেঁয়াজের আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের কৃষক পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পান না। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ পচে নষ্ট হয়ে যায়।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষের করুণ অবস্থা। তারা এখন আর পেঁয়াজ খেতে পারছে না। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারই পেঁয়াজ খাওয়া বাদ দিয়েছে। কিন্তু এটা কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের নৈরাজ্য আর কতদিন চলবে। এমন অরাজক পরিস্থিতির দ্রম্নত অবসান জরুরি।

এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, রাতারাতি কোটিপতি হতে নেমেছিলেন মাছ, তেল, চাল, ফল ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। এ জন্য ৪৭ আমদানিকারককে শুল্ক গোয়েন্দার মুখোমুখি করা হচ্ছে। পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৫৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। মোট ৪৭ পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শুনানি গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে আজ ১০ আমদানিকারকের শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কার্যালয়ে পেঁয়াজ নিয়ে শুনানি শুরু হয়। ১০ আমদানিকারক গত আগস্ট থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫৯ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে মোট ৪৪ হাজার ৩১ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে। সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিএম এন্টারপ্রাইজ। এ আমদানিকারক এ সময়ে ৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যে ৯ হাজার ২০ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে। মিয়ানমার থেকে নৌপথে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। সোমবার ২১টি ট্রলারে ১ হাজার ১০৩টন পেঁয়াজ এসে পৌঁছেছে। গতকাল রোববার এসেছিল ৭৯০টন পেঁয়াজ। অন্যদিকে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করেছে এনবিআর। আমাদের কথা হচ্ছে, যে ধরনের পদক্ষেপই সরকার নিক না কেন, বাজারে এর প্রভাব পড়ছে কিনা সেটাই মূল বিষয়। রসনাবিলাসের জন্য পেঁয়াজের গুরুত্ব অপরিসীম। রন্ধনশিল্পে পেঁয়াজ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিদিনের রান্নায় পেঁয়াজের জোগান জরুরি। তাছাড়া পেঁয়াজের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। পেঁয়াজে থাকা এলিসিন নামের উপাদান অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় এটি কিছু কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস, রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা ঠিক রাখা, বস্নাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে পেঁয়াজের ব্যবহার দেখা যায়। পেঁয়াজ কাঁচা খেলে সর্দি-কাশি খুব কম পরিমাণে হয়। এটা মানুষের শরীরকে রোগ-প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। পেঁয়াজের রয়েছে বেশ কিছু স্বাস্থ্যগুণও। সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চাহিদা রয়েছে পেঁয়াজের। পেঁয়াজ আসলে কোনো সবজি নয়। এটি আসলে একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। ফসল না হয়ে মসলাজাতীয় উদ্ভিদ হওয়ার কারণে সরকার এতদিন এটাকে খুব গুরুত্ব দেয়নি। ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ২৫০ টাকা হয় কীভাবে। এটা হচ্ছে মূলত ব্যবসায়ীদের নীতিহীনতা এবং জনসাধারণের পকেট কাটা। এর আগেও তারা চাল, পেঁয়াজ ও চিনির দাম বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছিল। লবণ সঙ্কটের গুজব ছড়িয়ে লবণের দাম বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে তা বন্ধ হয়েছে।

এসব হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি। এরা জনগণের স্বার্থের দিকে নজর দেয় না। এরা বাজারসন্ত্রাসী। কীভাবে অসৎ উপায় অবলম্বন করে দ্রম্নত ধনী হবে এটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তারা একেক সময় একক অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ায়। তাদের অজুহাতের শেষ নেই। আরও অবাক ব্যাপার, বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আর আগের অবস্থায় ফিরে যায় না। ফলে তাদের কাছে দেশের অসহায় জনগণ জিম্মি হয়ে পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষ সরকারও তাদের কাছে জিম্মি। বাজার নিয়ে অতীতে অনেক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বিক্রেতাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এ দেশের জনগণ আর কতকাল বাজারসন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি থাকবে?

তবে সবার আগে অসৎ ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে ততদিন পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির থাকবেই এবং দেশের জনগণও তাদের কাছে জিম্মি থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর ও কঠোর উদ্যোগই পারে জনগণকে হয়রানি ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে। জনগণকে অসহায়ত্বে বা জিম্মিদশায় ফেলে দেয়া কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ নয়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ভালো কথা, সেই উন্নয়নের সুফল যেন সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। গত দুই মাসে কেবল পেঁয়াজ থেকে তারা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যারা এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক এবং এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এর অন্য বিকল্প নেই।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77226 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1