শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আপত্তি উপেক্ষা করে পাস ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

বিতকির্ত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো এ আইনেও চারটি ধারায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রাখা হয়েছে আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে, ১৮০ কাযির্দবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে কোনো বাংলাদেশি এই আইন লঙ্ঘন করলে তার বিচার করা যাবে
যাযাদি রিপোটর্
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:৩২

জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে শেষ পযর্ন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়েছে। বুধবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আপত্তির মুখে বিলটি পাস হয়।

এই আইনে বলা হয়েছে, আইনটি কাযর্কর হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হবে। তবে এই আইনটিতেই বিতকির্ত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো চারটি ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া পুলিশকে পরোয়ানা ও কারও অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই আইনে ঢোকানো হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের সমালোচিত আইন ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’। আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এই আইন লঙ্ঘন বা এমন অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।

এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কাযির্দবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ে সম্ভব না হলে সবোর্চ্চ ৯০ কাযির্দবস সময় বাড়ানো যাবে। আইনে বলা হয়েছে, তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর বিধানাবলি কাযর্কর থাকবে।

আইনে ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদশর্ক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ; ধমীর্য় অনুভূতিতে আঘাত; আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে অপরাধে জেল জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্যও আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি তুলেন। তবে সেসব আপত্তি টেকেনি।

ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিরোধী দল জাতীয় পাটির্র ১১ জন ও স্বতন্ত্র একজন সাংসদ বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই ও আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার প্রস্তাব দেন। তবে এর মধ্যে তিনজন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন না। আর জাতীয় পাটির্র কাজী ফিরোজ রশীদ তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন।

বিরোধী দলের সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, অংশীজনদের আপত্তি ও বিতকির্ত ধারাগুলো অপরিবতির্ত রেখে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা খুবই উদ্বেগজনক। একদিকে বিলের ৮, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারার বিষয়ে গণমাধ্যমকমীের্দর উদ্বেগ ও মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যা তাদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে বিতকির্ত ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ অনুসরণের সুপারিশ করার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। নিবতর্নমূলক এই আইন সংযোজনের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেন।

ফখরুল ইমাম বলেন, প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারার অপপ্রয়োগের ফলে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী দুনীির্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত আইনি অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হবে। ফলে এই ধরনের অপরাধের আরও বিস্তার ঘটবে। এ ছাড়াও অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতা ও যে কোনো ধরনের গবেষণামূলক কমর্কাÐ পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এটি আইনে পরিণত হলে তা সংবিধানের মূল চেতনা, বিশেষ করে মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি কল্যাণ, দুনীির্ত প্রতিরোধ ও সুশাসন নিশ্চিতের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটি তাতে বাধা সৃষ্টি করবে। গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের ভূমিকা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। গণমাধ্যমসহ সকল নাগরিকের সমস্ত ধরনের ভয়ভীতির ঊধ্বের্ থেকে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান এবং বাধাহীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে তার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে তিনি জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন।

বিরোধী দলের সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতামত ও চিন্তার স্বাধীনতার যে কথা বলা হয়েছে, এই আইন হবে তার সঙ্গে সাংঘষির্ক। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক জায়গায় ৫৭ ধারার ভীতি আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বিরোধী দলের এই সাংসদ বলেন, সম্পাদকদের উদ্বেগের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা দেয়া হলেও আইনে তা প্রতিফলিত হয়নি। এই আইন গণমাধ্যমকে ক্ষুব্ধ করবে। নিবার্চনের আগে সমাজের এ রকম একটি বিশাল প্রগতিশীল অংশকে ক্ষুব্ধ করা ঠিক হবে না।

নুরুল ইসলাম মিলন, নুর ই হাসনা লিলি চৌধুরী, মাহজাবিন মোশের্দ, রওশন আরা মান্নান ও শামীম হায়দার পাটোয়ারী, মোহাম্মদ নোমান বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই ও আরও পরীক্ষা নীরিক্ষা করার প্রস্তাব দেন।

কাজী ফিরোজ রশীদ তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে বলেন, সময়োপযোগী বিলটি আরও আগে আসা উচিত ছিল। প্রচুর যাচাই-বাছাই হয়েছে, কালক্ষেপণ না করে আইনটি পাস করা হোক।

সাংসদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির রিপোটর্ দেখলে দেখা যাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কী পরিমাণ আলোচনা করেছি। আইনমন্ত্রী যে কতবার তাদের সঙ্গে বসেছেন, পরামশর্ নিয়েছেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মতামতকে সবোর্চ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। যেটা সংসদে উত্থাপিত বিল ও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করলে স্পষ্ট হবে। তারা যেসব বিষয়ে একমত হয়েছেন তাসহ যেসব জায়গায় যে ধরনের সংশোধন করা দরকার আমরা করেছি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘সম্পাদক পরিষদ নেতারা সংসদীয় কমিটি ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যে কথাগুলো বলেছেন, তা সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন। না হলে এই বিল সম্পকের্ তাদের সমালোচনার অবস্থান বিরাজ করে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করার উপায়টি এই আইন খুলে দেবে।’

মোস্তফা জব্বার বলেন, সাংবাদিকরা ৩২ ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেখানে তারা গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলেছিলেন-সংসদীয় কমিটি সেটাকে সংশোধন করে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কথা বলেছেন। এই আইনের অপপ্রয়োগের নজির নেই।

মোস্তফা জব্বার দাবি করেন, তারা সাংবাদিকদের সামনে সব উপস্থাপন করেছেন। তাদের কথা অনুসারে যেসব ক্ষেত্রে পরিবতর্ন দরকার তার সবই করেছেন। সংবাদপত্র দমন বা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন নয়। এই আইন কেবল ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য।

ভবিষ্যতে ডিজিটাল যুদ্ধ হবে উল্লেখ করে মোস্তফা জব্বার বলেন, এই যুদ্ধে যদি রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দিতে না পারে, রাষ্ট্র যদি বিপন্ন হয় তাহলে অপরাধটা আমাদেরই হবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না।

মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘এই আইনটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক আইন। আমরা একটি ঐতিহাসিক কাজের সাক্ষী হয়ে সংসদে থাকছি।’

পরে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। তবে ফখরুল ইমামের দেয়া একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। এই আইন কাযর্কর হলে তথ্যও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল হবে। তবে এসব ধারায় বিচারাধীন মামলা এসব ধারাতেই চলবে।

গত ২৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করেছিল মন্ত্রিসভা। তখন থেকে এই আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষ আপত্তি জানিয়ে আসছে। সম্পাদক পরিষদ এই আইনের ৮টি (৮,২১, ২৫,২৮, ২৯,৩১, ৩২ ও ৪৩) ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এসব ধারা বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হতে পারে। এ ছাড়া ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক‚টনীতিকেরা এই আইনের ৪টি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৯টি ধারা পুনবিের্বচনার আহŸান জানিয়েছিল।

আপত্তির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এই প্রেক্ষাপটে গত ৯ এপ্রিল বিলটি পরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠায় সংসদ। সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠন সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনাসের্র প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিলটি নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত আইনে বড় কোনো পরিবতর্ন আনা হয়নি। যে ধারাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি ছিল, তার কয়েকটিতে কিছু জায়গায় ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা, সাজার মেয়াদ কমানো এবং শব্দ ও ভাষাগত কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13466 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1