শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
কোচিংবাণিজ্য

নীতিমালায় ফঁাক খঁুজছেন শিক্ষকরা

নতুনধারা
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
একটি কোচিং সেন্টারে কয়েকজন শিক্ষাথীর্

সাখাওয়াত হোসেন

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের হিসাব বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক বছরের শুরু থেকেই ছুটির পর স্কুল ক্যাম্পাসে নবম ও দশম শ্রেণির ডজন দেড়েক ছাত্রীকে কোচিং করাচ্ছিলেন। বাইরে যেয়ে কোচিং করার ভোগান্তি না থাকায় অভিভাবকরা অনেকে ওই শিক্ষকের কাছে সন্তানদের পড়তে দিয়েছেন। তবে ৭ ফেব্রæয়ারি উচ্চ আদালত কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে সরকারি অনুমোদিত নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করায় বেশখানিকটা বিপাকে পড়েছেন ওই শিক্ষক। কেননা এরইমধ্যে স্কুল কতৃর্পক্ষ ক্যাম্পাসে এভাবে কোচিং করানো যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় তিনি তার নিজ বাসায় শিক্ষাথীের্দর পড়ানো শুরু করেছেন।

তার দাবি, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালায় সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং করানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রাইভেট টিউশনির ব্যাপারে তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই। তাই তিনি নিয়মমাফিক স্বল্প সংখ্যক শিক্ষাথীের্ক নিজ বাসায় পড়াচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো বেতনও নিচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষক সপ্তাহ দুয়েক ধরে তার একজন শিক্ষাথীর্র বাসায় নিজ ক্লাসের বেশ কয়েকজন শিক্ষাথীের্ক প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। তার ভাষ্য, ‘শিক্ষাথীর্র গৃহে পাঠদান প্রাইভেট টিউশনির পযাের্য় পড়ে। এটিকে কোনোভাবেই কোচিং বাণিজ্য বলা যাবে না।’

তবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালায় নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাথীের্দর প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তিনি কিভাবে এ শতের্র পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন- এ ব্যাপারে ওই শিক্ষক সরাসরি কোনো কথা বলতে চাননি।

খেঁাজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এই দুই শিক্ষকই নন, বিগত সময় যারাই কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন তারা সবাই এখন নীতিমালার ফঁাক-ফোকর খুঁজতে আদা-জল খেয়ে লেগেছেন। শিক্ষাথীের্দর প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ হলে শিক্ষার গুণগত মান কমবে বলেও তারা নানা যুক্তি তুলে ধরছেন।

এছাড়াও সম্প্রতি কক্সবাজারে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল গণমাধ্যমকে ‘কোচিং ও কোচিং বাণিজ্য এক নয়’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন কোচিংবাজ শিক্ষকরা সেটিকেও ‘পুঁজি’ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

এ অবস্থায় অভিভাবকদের শঙ্কা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ তে যেসব ফঁাকফোকর রয়েছে, তা গলে কোচিংবাজ শিক্ষকরা অনায়াসে পার পেয়ে যাবেন। তারা নতুন ফন্দিতে ফের এ বাণিজ্য জাকিয়ে বসবেন। যার বেশকিছু আলামত এরইমধ্যে দেখা গেছে বলে জানান অভিভাবক ফোরামের একাধিক নেতা।

তাদের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয় তা বেশকিছু কোচিংবাজ শিক্ষকের গতিবিধি পযের্লাচনা করে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে খ্যাতনামা স্কুলের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাথীের্দর কৌশলে কোচিং করানোর যে ছক কষছে, তাতে নীতিমালার আলোকে তাদের বিরুদ্ধে আদৌও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরইমধ্যে বেশকিছু শিক্ষক আগামী মাচর্ মাস থেকে নিজ বাসায় কোচিং করানোর বন্দোবস্ত করেছেন। এজন্য কেউ কেউ নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে বাসা ভাড়াও নিয়েছেন। স্কুলের ছুটির পর শিক্ষাথীর্রা যাতে নিবিের্ঘœ সেখানে যেতে পারে তারও ব্যবস্থা রাখছেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি যাতে এ ব্যাপারে বাধা না হয়ে দঁাড়ায় এজন্য তারা জোরদার লবিং চালাচ্ছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ এর বেশকিছু দুবর্ল দিক রয়েছে। কোচিংবাজ শিক্ষকরা ওইসব দুবর্লতার ফঁাক দিয়েই মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সবোর্চ্চ ১০ জন শিক্ষাথীের্ক প্রাইভেট পড়ানোর যে অনুমতি দেয়া হয়েছে- এ সুযোগ তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। এজন্য তারা নিজেদের মধ্যে ‘ইন্টারচেঞ্জ’ কৌশল বেছে নিয়েছেন। এ পন্থায় খ্যাতনামা এক স্কুলের শিক্ষক তার নিজের শিক্ষাথীের্দর অপর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিংবাজ শিক্ষকের কাছে পাঠাবেন। একইভাবে তিনিও তার শিক্ষাথীের্দর ওই শিক্ষকের কাছে কোচিং করানোর বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিশ্বাস, বিগত সময় কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নানা হঁাকডাক দিয়েও নজরদারির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তেমনি এ ধরনের কৌশল ভেঙেও সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যথর্ হবে।

এদিকে শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, শ্রেণি কক্ষে শিক্ষকরা ঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কিনা সে ব্যাপারে জোরালো কোনো উদ্যোগ না নিয়ে শুধু কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা হলে শিক্ষাথীর্রা মহাবিপাকে পড়বে। ক্ষুব্ধ কোচিংবাজ শিক্ষকরা শিক্ষা খাতে বড় ধরনের ধস নামাতে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে পারেন বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অনেকেই।

তাদের এ আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, তা স্বীকার করেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ পারিপাশ্বির্ক বাস্তবতা যেখানে এসে ঠেকেছে সেখানে কোচিং নিষিদ্ধ করে দেয়ার জো আর নেই। নিষিদ্ধ করলে বরং এর প্রতি ঝোঁক আরও বাড়বে। উচ্চবিত্তরা ঠিকই বাসায় টিউটর রেখে তাদের সন্তানদের পড়াবে। তবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য তা বোঝা হয়ে দঁাড়াবে। যা সবার জন্য শিক্ষা- এ ব্যবস্থার প্রধান অন্তরায় হবে।

এ ব্যাপারে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সরকার আব্দুল মান্নান বলেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালায় কোনো শাস্তির বিধান নেই। তাই কোচিং বাণিজ্য বন্ধে এ নীতিমালা যথেষ্ট নয়। সুনিদির্ষ্ট আইন থাকলে কোচিং বাণিজ্যে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা যেত। শিক্ষা আইন এ ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত কোচিং বাণিজ্য প্রতিরোধ বিষয়ে এ শিক্ষাবিদ জানান, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত ফলাফলমুখী। বিশেষত অভিভাবকরা সন্তানদের কাছ থেকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই শুধু আশা করেন। এ কারণে কোচিং বাণিজ্য সামাজিক আনুক‚ল্য পাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সৈয়দা তাহমিনা আক্তার বলেন, টাকা দিলেই ভালো শিক্ষা মেলে এমন একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এ প্রবণতা জাতীয় মেধাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই শিক্ষাকে পরীক্ষামুখী নয়, জ্ঞানমুখী করতে হবে। এ জন্য আগে কোচিং বন্ধ করে শিক্ষকদের ক্লাসে মনোযোগী হতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নিবার্হী পরিচালক শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পযাের্য় পরীক্ষার সংখ্যা বেশি হওয়ায় শিক্ষাথীর্রা বেশি করে পরীক্ষামুখী হয়ে পড়েছে। তারা ভালো ফলাফলের জন্য যতটা আগ্রহী, শিক্ষায় ততটা নয়। ফলাফলমুখী তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে শিক্ষায় কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনি নিভর্রতা বেড়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যয়ের বড় একটি অংশ কোচিং ও টিউশনি খাতে ব্যয় হচ্ছে। তিনি মনে করেন, নীতিমালা করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার সুযোগ কম। এ সংক্রান্ত আইন থাকলেই কেবল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<37071 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1