শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুলাউড়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা

উপবন এক্সপ্রেসের ৭ বগি লাইনচু্যত ৪ জন নিহত, আহত দুই শতাধিক ঘুম থেকে উঠে উদ্ধার কাজে সাধারণ মানুষ
আবদুল আহাদ, কুলাউড়া
  ২৫ জুন ২০১৯, ০০:০০
সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি রোববার রাতে কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনসংলগ্ন বড়ছড়া রেল ব্রিজের ওপর বিকট শব্দে ছিটকে পড়ে -যাযাদি

সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশন সংলগ্ন বড়ছড়া রেল ব্রিজের ওপর এলে বিকট শব্দে ছিটকে পড়ে ৩টি বগি, এতে ঘটনাস্থলে নিহত হয় নারীসহ ৪ যাত্রী। আহত হয় দুই শতাধিক যাত্রী। স্মরণকালের এ ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে রোববার রাত পৌনে ১২টায়। বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রেন যোগাযোগ।

রেলসচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন সোমবার সকালে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে ৭টি বগি রেখে ৬টি বগি নিয়ে ভোর রাত ৩টায় কিছু যাত্রী নিয়ে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে কুলাউড়া স্টেশন ছেড়ে যায়। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়া স্টেশনে সিলেটের যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। পরে যাত্রীরা সড়ক পথে সিলেটে যান। সোমবার সন্ধ্যা থেকে কুলাউড়া জংশন স্টেশন থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।

নিহত ৪ যাত্রীর মধ্যে ৩জন নারী ও একজন পুরুষ। নিহতরা হলেন, কুলাউড়া পৌরসভার বাসিন্দা ও ঠিকাদার আব্দুল বারির স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন (৪৫), সিলেটের মোগলাবাজারের আব্দুলস্নাহপুর গ্রামের আব্দুল বারির মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২২), সানজিদা আকতার (২২) এবং হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ডবলডর গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে কাউসার আহমেদ (২৬)। ইভা ও সানজিদা উভয়েই সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং ইন্সটিটিউটের ছাত্রী। নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

অন্য আহতরা কুলাউড়া হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাজার মুসলিম এইড হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল ও সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

সরেজমিন ঘটনাস্থলে গেলে বরমচাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান, স্থানীয় বাসিন্দা পারভেজ আহমদ, মিরাজ আহমদ, সুলতান আহমদ এবং ভাটেরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন বরমচাল স্টেশন অতিক্রমকালে খুব দ্রম্নত গতি ছিল। স্টেশন অতিক্রম করার পরপরই এক বিকট শব্দ শোনা যায়। সাথে সাথে মানুষের আর্তচিৎকার শুরু হয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় কবলিত হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় কালা মিয়া বাজারের মসজিদের মাইকে ট্রেন দুর্ঘটনার ঘোষণা দেয়া হয় এবং স্থানীয় লোকজনকে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণা শুনেই আশপাশের কয়েক শতাধিক লোকজন ঘুম থেকে জেগে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং উদ্ধার কাজে অংশ নেন। এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত বগির প্রায় ৩৫ জন যাত্রী রাতে আশ্রয় নেন বরমচাল টিকরা জামে মসজিদে। স্থানীয়দের মতে, দ্রম্নত গতি আর অতিরিক্ত যাত্রীর কারণেই ট্রেনটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। তবে বড়ছড়া নামক পাহাড়ি ছড়ার উপর নির্মিত ৯নং রেল ব্রিজটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রেলওয়ে নিরাপত্তা পুলিশ, কুলাউড়াসহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন থানা পুলিশ, সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে ২ পস্নাটুন বিজিবি,র্ যাব এবং মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট রাতে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মাঝ রাতে ঘন অন্ধকার থাকায় উদ্ধারকারী দল ট্রেনের বগিগুলোতে তাদের উদ্ধার কাজ বন্ধ রাখে। সকালবেলা পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করলেও কোনো হতাহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সোমবার সকাল ৯টায় আখাউড়া থেকে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে ছিটকে পড়া বগির উদ্ধার কাজ শুরু করে।

ভয়াবহ ট্রেন দুঘটনা কবলিত আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ঢ বগির যাত্রী পাবনার মো. আল আমিন ও মো. সম্রাট পারভেজ জানান, তারা ১৪ জন মিলে সিলেটে মাজার জিয়ারতে এসেছিলেন। সড়কপথ বন্ধ থাকায় তারা ট্রেনের টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। দুর্ঘটনার পর ভয়ে তারা ট্রেন থেকে নেমে টিকরা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। মসজিদে রাত কাটান। ভোর ৭টায় তারা সড়ক পথে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। তারা ক্ষোভের সাথে জানান, এটা কোনো ট্রেন হলো। টিকিট কেটে সিটে বসলাম। কিন্তু কাঁধের উপর লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনের টিকিটধারী যাত্রীর চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী ছিল দাঁড়ানো। আর যাত্রা শুরুর পর ট্রেনটি খুবই দ্রম্নত গতিতে চলছিল। তখনই মনে হয়েছিল, কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দে বগিটি ব্রিজ থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়।

দুর্ঘটনা তদন্তে ২ কমিটি

দুর্ঘটনার খবর পেয়েই রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন সকাল ৮টায় এসে কুলাউড়ায় পৌঁছান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে। এই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জলিল, চিফ পিএসপি মইনুল ইসলাম, চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) চিফ সুজিপ কুমার। এ ছাড়াও ৫ সদস্য দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা হলেন- চিফ সিগন্যাল অ্যান্ড কমিনিউকেশন মঈনুল ইসলাম, সিওপিএস সুজিত কুমার, রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম, অতিরিক্ত সচিব মো. মুজিবুর রহমান, চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান।

এর আগে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রোববার রাতে তাৎক্ষণিকভাবে সিলেটে বিভাগীয় কমিশনার মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার পর রাত কিংবা পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। দুপুর ১২ নাগাদ কুলাউড়ার রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জুয়েল হোসাইন মোবাইল ফোনে জানান, প্রায় ২শ মিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকাল থেকে ২ শতাধিক শ্রমিক মেরামত কাজ করছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল জানান, দুর্ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন। পরবর্তীতে খবর পেয়ে মৌলভীবাজারের প্রায় সবক'টি থানার পুলিশ এবং বিজিবি সদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।

হাসপাতালে রাতভর স্বজনদের আহাজারি

আহত ও নিহতদের দেখতে রাতভর কুলাউড়া সদর হাসপাতালে ভিড় করেছেন সহস্রাধিক মানুষ। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ট্রেনে থাকা যাত্রীদের স্বজন। স্বজনের খোঁজে এসে শত শত মানুষের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। অ্যাম্বুলেন্স বা আহত যাত্রী বহনকারী যে কোনো গাড়ি এলেই ছুটে যান স্বজনরা। এ-গাড়ি থেকে ও-গাড়ি দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করেন স্বজনরা। কেউ কেউ তাদের আপনজনকে পাচ্ছেন আবার কেউ কেউ না পেয়ে জোর গলায় কান্না করে আপনজনের সন্ধান চাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যে পুরো রাত ছিল কুলাউড়া হাসপাতালটি।

৯৯৯-এ ফোন: রক্ষা পেল বহু প্রাণ

হঠাৎ বিকট শব্দ এবং মানুষের আর্তচিৎকার শুনে তাৎক্ষণিক ন্যাশনাল ইমারজেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন শাহীন আহমদ শাহান নামক স্থানীয় এক যুবক। মুঠোফোনে ট্রেন দুর্ঘটনার ভয়াবহ খবর দিলে চমকে ওঠে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হন পুলিশ সদস্যরা। যথাস্থানে পৌঁছে দেখেন ঘটনা সত্য। তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন তারা। এ নিয়ে ৯৯৯ ফোন দেয়া শাহান কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কুলাউড়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ এখনো জানা যায়নি। তদন্তে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। রেলওয়ের স্পেশালিস্ট ছাড়া দুর্ঘটনার কারণ বলা যাবে না। সোমবার সকাল পর্যন্ত মোট ৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জেলা প্রশাসক জানান।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, যত দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে সম্ভব রেললাইন মেরামত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের উদ্ধারকারী ট্রেন এসে পৌঁছেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এ লাইন চালু করব। আপাতত কুলাউড়া পর্যন্ত সব ট্রেন আসা-যাওয়া করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55232 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1