শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আলাদা সূচক তৈরি হচ্ছে

ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে না এলে ভেস্তে যাবে পরিকল্পনা

বাজার স্বাভাবিক ধারায় আনতে নয় বছর ধরে চেষ্টা চলছে মানহীন কোম্পানিতে ঠাঁসা শেয়ারবাজার ২০টির বেশি মৌলভিত্তির কোম্পানি নেই পুঁজিবাজারে
নতুনধারা
  ১২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল

শেয়ারবাজার যেন বিনিয়োগকারী ও সরকারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর বাজার স্বাভাবিক ধারায় আনতে নয় বছর ধরে চেষ্টা চলছে। দেওয়া হয়েছে নানা আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি-সহায়তা। কোনো কিছুই কাজে আসেনি। উল্টো বাজারের আরও অবনতি হয়েছে।

নতুন করে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে আলাদা একটি সূচক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা মৌলভিত্তির কোম্পানি নিয়ে আলাদা এই সূচকটি তৈরি করা হবে। এই সূচকে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানি বাছাই করা হবে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী। ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ এই সূচক তৈরির কাজ করছে। চলতি বছরের মধ্যে সূচকটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বৃহস্পতিবার চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জে অনুষ্ঠিত 'চায়না-বাংলাদেশ পুঁজিবাজার সহায়তা' শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এই পরিকল্পনার কথা জানান সংস্থার আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক লিউ ফুজং। তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাজারে ভালো কোম্পারি সংখ্যা বাড়ানো বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসাটা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে আলাদা সূচক তৈরির উদ্যোগকে কিছুটা ইতিবাচবক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ। তবে, ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে না আনতে পারলে তাদের এ উদ্যোগ ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, তাদের বিনিয়োগ করার মতো খুব বেশি ভালো কোম্পানি দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নেই। এই উদ্যোগে পুঁজিবাজারের জন্য ভালো কিছু হবে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ হিসেবে বলেন, বাজারে ২০টি বেশি ভালো কোম্পানি নেই। তারা মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চায়। ভালো হয়, ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে নিয়ে আসা। তখন এমনিতেই তারা বিনিয়োগে আসবে।

অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ এমনিতেই ডিএসইর কৌশলগত পার্টনার। তারা তো বাংলাদেশের মার্কেটে বিনিয়োগ করে না। বরং শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যায়। যেমনটি অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীও করছেন। এখন তারা বিনিয়োগ করতে চান ভালো কথা। কিন্তু ভেতর থেকে এ অর্থনীতিবিদ বোঝেন, দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে নেই। ভালো কোম্পানি না থাকলে, তারা কোথায় বিনিয়োগ করবে। যেমন, বহুজাতিক বড় কোম্পানির মধ্যে কয়েকটি হলো- ইউনিলিভার, নেসলে, ইনসেপ্টার মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। এদের মতো কোম্পানি পুঁজিবাজারে না এলে চায়নারা একসময় সটকে পড়বে।

তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে আলাদা সূচকের সফলতা দেখতে হলে সরকারের উদ্যোগে ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে নিয়ে আসাটা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ বলছে, ডিএসই তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা মৌলভিত্তির কোম্পানি নিয়ে আলাদাভাবে সূচকটি তৈরি করবে। কিন্তু বাজারে বড়জোর মৌলভিত্তির ২০টির বেশি কোম্পানি নেই। ভালো শেয়ার না এলে অন্যান্য উদ্যোগের মতো চীনের এই উদ্যোগও নিষ্ফল ও ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ অধ্যাপক।

এদিকে, অনেক বছর আগ থেকে দেশে ব্যবসারত বহুজাতিক ৪১ কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসতে চায় না। শেয়ারবাজারে এলে অনেক বিধিবিধান মেনে চলতে হবে তাদের। এমন বাধ্যবাধকতায় জড়াতে চায় না কোম্পানিগুলো। এ কারণে পুঁজিবাজারে আসছে না তারা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে ব্যবসা করে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের মুনাফা করছে। এসব মুনাফার বড় একটি অংশ নগদ আকারে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না থাকায় তেমন সুফল পাচ্ছে না দেশের মানুষ।

আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে মৌলভিত্তিসম্পন্ন ভালো কোম্পানির ঘাটতি রয়েছে। দেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে এর সবই ভালো মানের কোম্পানি। অবশ্য বহুজাতিক কিছু কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিঙ্গার, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, রেনাটা, বাটা, গ্রামীণফোন উলেস্নখযোগ্য। এগুলো প্রতিবছর ভালো মুনাফা দিচ্ছে। তবে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনতে প্রচলিত বিধিবিধান কিছুটা শিথিল করার সুপারিশ করে। শেয়ারবাজারে এলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পর পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের জানাতে হয়। এতে অনীহা রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের শেয়ার তিন বছরের লক-ইন থাকে। ইচ্ছা করলেও ওই সময়ে তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না। মুনাফার একটি অংশ স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের দিতে হয়। এসব বিধিবিধান পরিপালনে তাদের অনীহা রয়েছে।

তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য বিদেশি উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন সহজকরণ, তালিকাভুক্তির আইনি বাধা দূর, ট্যাক্স হলিডে প্রদান এবং শুল্ক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। তারপরও বাংলাদেশে এসব বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার শেয়ারবাজারে ৩৫০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১টি বহুজাতিক, যা বাজার মূলধনের মাত্র ৭ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে প্রায় ৪১টি বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানি কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই ব্যবসা করছে। শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তবে, এজন্য আরো আইনি যেসব বাধা রয়েছে তার দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে, চলতি বছরের বেশিরভাগ সময় শেয়ারাবাজারের অবস্থা খারাপ গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক কমতে কমতে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে এসেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শেয়ারাবাজার ঠিক করতে বাজেটে চমক দেখানোর আগাম ঘোষণা দেন। বাজেটে করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা বাড়ানো হয়। নগদ লভ্যাংশে উৎসাহিত করতে অবণ্টিত মুনাফা এবং অধিক বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার ওপর কর আরোপ করেন। কিন্তু বাজার প্রতিনিয়ত পতনের দিকেই আছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে যে কারসাজির ঘটনা ঘটছে, সেসব ঘটনায়ও কারও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়নি। এ অবস্থায় বাজারে নতুন বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো মানহীন কোম্পানির মাধ্যমে বাজার থেকে নানাভাবে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই বিনিয়োগকারীদের এখন সবচেয়ে বেশি অনাস্থা। ফলে বর্তমান কমিশনের কোনো উদ্যোগেই এখন বিনিয়োগকারীরা আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন না।

তবে ডিএসইর সভাপতি অধ্যাপক আবুল হাশেম বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনার কথা বলছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাই চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে উভয়ই লাভবান হবে।

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বাজারের সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ১৩-এর কাছাকাছি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গড় লভ্যাংশের পরিমাণ ৫ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি নিয়ে যাত্রা শুরু করে সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২ হাজার ১৭০টি। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বন্ডের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৩৯টি। বাজার মূলধন ২ হাজার ৪০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে ডিএসইর মালিকানায় যুক্ত হয় চীনের সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75153 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1