দেশে ১৬ কোটি মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক সমস্যাজনিত রোগের চিকিৎসায় মাত্র ১৬০ জন নিউরোসার্জন রয়েছেন। যা প্রতি ১০ লাখে (এক মিলিয়ন) মাত্র একজন।
জানা গেছে, বিগত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠলেও এখন পর্যন্ত কোনো উপজেলা হেলথ কমপেস্নক্সেই নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারি চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি হয়নি। আবার জেলা শহরে স্থাপিত মেডিকেল কলেজের বাইরে জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালেও কোনো নিউরোসার্জন নেই। ফলে বিভিন্ন সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলেই তাদের রাজধানী বা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার্ড করা হচ্ছে। এতে করে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে অনেকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
নিউরোসার্জারি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ বছর আগে (২০০৯ সাল) দেশে ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এই সংখ্যা এখন ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা যেমন; আরটিএ আই হেড ইনজুরির মতো রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। অথচ সারাদেশের রোগীদের চিকিৎসা দিতে মাত্র ১৬০ জন নিউরোসার্জন কাজ করছেন। চলমান রোগীর সংখ্যার বিপরীতে যে সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ফলে যেসব মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারি কোর্স চালু আছে, সেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তি সংখ্যা বাড়ানো ও ৮টি পুরনো মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারি কোর্স চালু করা জরুরি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের উপযুক্ত পদায়নের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রয়োজনীয় নিউরোসার্জারি সেবা দিতে ১৪টি পুরনো মেডিকেল কলেজে নতুন পদ সৃষ্টির কথা বলছেন তারা।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষের চিকিৎসায় ১৬০ জন নিউরোসার্জন আছেন। যা প্রতি ১০ লাখ বা এক মিলিয়ন জনসংখ্যার অনুপাতে মাত্র একজন। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১ জন করে নিউরোসার্জন রয়েছে। সে হিসাবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬০০ জন নিউরোসার্জন প্রয়োজন। আর নূ্যনতম চাহিদায় প্রতি ৫ লাখ মানুষের জন্য ১ জন করে হলেও দরকার ৩০০ জন।
নিউরোসার্জন্স সোসাইটির একাধিক চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, সারাদেশের সাধারণ রোগীদের জন্য শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে নিউরোসার্জারি রোগীদের জন্য ৬৩০টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে বিএসএমএমইউতে ১২৫, ঢামেকে ২৯০, মিডফোর্ডে ১২, ময়মনসিংহ মেডিকেলে ৮, চট্টগ্রামে ৯৫, রাজশাহীতে ৪০, কমবাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল বা (সিএমইএইচ)-এ ৩০ এবং এর বাইরে বেসরকারি চিকিসাকেন্দ্র হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০টি বেড ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার অনুযায়ী কিছু সংখ্যক শয্যা রয়েছে।
এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি চিকিৎসার চিত্র সম্পর্কে সেখানকার একাধিক চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে ২০০১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগে ৭ হাজার ৪ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এতে করে সহজেই বোঝা যায় বর্তমানে ঢামেকের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীর সংখ্যা কত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বর্তমানে নিউরোসার্জারিতে বিভিন্ন সাব স্পেশালিস্ট যেমন- স্কালবেইজ, পেডিয়াট্রিক, ভাস্কুলার, এন্ডোসপিক ও অনকোলজির মতো ইউনিট চালু হচ্ছে। এটি বিশেষায়িত সেবা হওয়ায় এ রোগের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির দরকার হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত অধিকাংশ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় ক্রানিওটোটাম, হাইস্পিড ড্রিল, অপারেটিং মাইক্রোস্কোপ, এন্ডোসকোপ, নিউরো নেভিগেটর ও নিউরো ক্যাথল্যাব চালু নেই। এতে করে দেশের বেশিরভাগ রোগীর নিউরোসার্জারি চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। যা তাদের জন্য বিড়ম্বনা ও প্রাণহানির বড় কারণ। মূলত নতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত নিউরোসার্জারি পদ না থাকায় এ চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্স-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম মোশারেফ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, নিউরো অ্যানেশথেসিয়, নিউরোরেডিওলজি, নিউরোপ্যাথলজির মতো সহযোগী বিষয়গুলোকে সমানভাবে বিকশিত করে রোগীদের উন্নত সেবা দানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। কারণ বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা পোস্টগ্রাজুয়েট তরুণ নিউরোসার্জনদের সুষমভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অনেকেই নিউরোসার্জিক্যাল কেন্দ্রসমূহে পোস্টিং নিতে পারছে না। ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নিউরোলজিক্যাল বিভাগগুলোতে আলাদা পদ সৃষ্টি করা জরুরি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্স-এর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আখলাখ হোসেন খান যায়যায়দিনকে বলেন, নিউরোসার্জারি একটি দ্রম্নত বিকাশমান ও প্রতিশ্রম্নতিশীল উচ্চ প্রযুক্তির বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। যুগ ও চাহিদার প্রত্যাশায় নিউরোসার্জারি বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। কিন্তু নানা অপ্রতুলতার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সব ধরনের স্নায়বিক রোগের মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মূলত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কেন্দ্রসমূহে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও লোকবলের অপ্রতুলতা, যন্ত্রপাতি ওষুধ-পথ্যের সংকট সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। তবে নতুন-পুরনো মেডিকেলে শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ানোর পাশাপাশি উপজেলা ও জেলাপর্যায়ের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি, পদায়ন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করা হলে এ সমস্যা থাকবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উলেস্নখ্য, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সময়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ কোটি মানুষের জন্য নিউরোসার্জন চিকিৎসক ছিলেন ৪ জন, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্য ৯ জন, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সাড়ে ১০ কোটি থেকে ১৩ কোটির জন্য ১২ জন, ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৩ থেকে ১৫ কোটি মানুষের চিকিৎসায় ৬১ জন, ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৬ কোটির জন্য ৬৮ জনসহ বর্তমানে ১৫৪ জন নিউরোসার্জন কাজ করছেন। এর বাইরে আগামী ৫ বছরে এর সঙ্গে আরও ৮০ থেকে ৯০ জন নিউরোসার্জন পাস করে বের হবেন।