শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
বিপদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

ব্যবহৃত সুরক্ষাসামগ্রী গৃহস্থালির বর্জ্যে

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৬ জুন ২০২০, ০০:০০
সড়কে ফেলে রাখা ব্যবহৃত গস্নাভস

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষের ব্যবহৃত সুরক্ষাসামগ্রী গৃহস্থালির বর্জ্যের সাথে মিশে যাওয়ায় বড় বিপদের শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে ব্যবহার করা গস্নাভস, মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজারের বোতলের মতো বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করে যথাযথ পদ্ধতিতে নিষ্কাশনের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর প্রায় তিন মাস পরে এসে এসব বর্জ্য পৃথকভাবে সংগ্রহের পরিকল্পনার কথা বলছে নগর কর্তৃপক্ষ। তবে বাসাবাড়ি থেকে সংক্রমিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই বেশি ভাবাচ্ছে কর্মকর্তাদের।

এই বাস্তবতার মধ্য 'প্রকৃতিকে বাঁচানোর এখনই সময়' স্স্নোগানে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করছে বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষের, যাদের অধিকাংশই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

আক্রান্তদের সৃষ্ট বর্জ্য ছাড়াও নগরবাসীর ব্যবহৃত সুরক্ষা সামগ্রী থেকেও প্রতিদিনই ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। পথেঘাটে যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে ব্যবহৃত গস্নাভস, মাস্ক ও স্যানিটাইজারের বোতল।

প্রিজম বাংলাদেশ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাসপাতালগুলো থেকে মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহে কাজ করে। তবে বাসাবাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য সংগ্রহে পৃথক ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে গৃহস্থালি আবর্জনার সাথে মিশে এ বর্জ্যগুলো চলে যাচ্ছে সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডোর জরিপ অনুযায়ী, সাধারণ ছুটির প্রথম মাসে দেশে ব্যবহৃত সার্জিক্যাল মাস্ক বর্জ্যের ২৮.২ শতাংশ, পলিথিন হ্যান্ড গস্নাভস বর্জ্যের ১৯.৮ শতাংশ, সার্জিক্যাল গস্নাভস বর্জ্যের ৪৬.৩ শতাংশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলের বর্জ্যের ৩০ শতাংশ ঢাকাতেই উৎপন্ন হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঢাকায় প্রতি মাসে সার্জিক্যাল মাস্ক থেকে ৪৪৭ টন, পলিথিন গস্নাভস থেকে ৬০২ টন, সার্জিক্যাল গস্নাভস থেকে ১৩১৪ টন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে।

এসব বর্জ্যের বড় অংশই বাসাবাড়ি থেকে আসছে। এছাড়া ফেস শিল্ড, গগলস, পিপিই, সাধারণ মাস্ক থেকেও উলেস্নখযোগ্য বর্জ্য তৈরি হচ্ছে।

এসডোর সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, 'আমরা যেহেতু এই বর্জ্যগুলো আলাদা করতে পারছি না, সেক্ষেত্রে ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে। কারণ কোনগুলোতে জীবাণু আছে আর কোনটিতে নেই- তা আমরা জানি না। বিভিন্ন বাড়িতে যারা ইনফেক্টেড আছেন, তাদের বর্জ্যগুলোও গৃহস্থালি বর্জ্যের সাথে চলে যাচ্ছে। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

'সাধারণ বর্জ্য থেকে এগুলো আলাদা না করলে পরিবেশে চলে যাবে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। এজন্য খুব দ্রম্নত আলাদাভাবে এ বর্জ্যগুলো সিল করা কনটেইনারে সংগ্রহ করা প্রয়োজন এবং মাটির অন্তত ১০ ফুট নিচে পুঁতে ফেলা প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, খোলা জায়গায়, নর্দমা, রাস্তাঘাট, নদীতে এ বর্জ্যগুলো ছড়িয়ে পড়লে অন্য প্রাণীও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেবে। তাতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।

ডিটারজেন্ট এবং বিস্নচিং পাউডারের মতো জীবাণুনাশকের ব্যবহার নিয়েও সতর্ক করেছেন ড. শাহরিয়ার।

'কীটনাশক যেমন মাটির ক্ষতি করে, এগুলোও তেমনি। এসবের অতিরিক্ত ব্যবহার ফসল উৎপাদন ব্যাহত করবে। উদ্ভিদের বন্ধু পোকার জন্যও এগুলো ক্ষতিকর। এগুলোর ব্যবহার কমাতে হবে। সরকারকে এটি প্রচার করতে হবে।

'কৃষি মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে এসবের বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে গবেষণা করে জনগণকে তথ্য দিতে পারে।'

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন শাহরিয়ার। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বড় বিপদের আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, '১০ কোটি মানুষ যদি দিনে একটি করেও মাস্ক, গস্নাভস ব্যবহার করে, তাহলে ১০ কোটি বর্জ্য হচ্ছে। এটি এক কোটি হলেও বিশাল। আর এগুলো তো শুধু বর্জ্য না, জীবাণু মেশা বর্জ্য।

'এ বর্জ্যগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হাসপাতালের ক্লিনারদের মতো ফুল পিপিই পরে এগুলো সংগ্রহ করা উচিত। কারণ আমরা এখনো নিশ্চিত না কিভাবে জীবাণুটি ছড়াচ্ছে। তবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এগুলোকে মেডিকেল বর্জ্য হিসেবে ধরতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো নদী, ড্রেন, রাস্তায় পড়লে সংক্রমণ হবে না বলা যাবে না।'

তিনি বলেন, এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য দুই ভাগে ভাগ করতে হবে বাসার বর্জ্য। বিশেষ বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে পৃথক করতে হবে গস্নাভস, মাস্কগুলো।

'এ বর্জ্যগুলো বিশেষভাবে নষ্ট করতে হবে। পোড়ানো বা জীবাণুমুক্ত করা- এই দুই পদ্ধতির একটি মেনে এগুলো ধ্বংস করতে হবে। এসবের ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে প্রতিরোধ টিম করা উচিত। তারা ট্রেনিং দেবে কীভাবে এটি করা উচিত। এটা আমাদের জীবনের পার্ট হয়ে গেছে, একে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আফরোজ সুলতানা চ্যামন বলেন, 'এসব ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ড্রেন বা সুয়ারেজ লাইনে জমা হচ্ছে। পস্নাস্টিকের জিনিসগুলো বছরের পর বছর নষ্ট হয় না, পরিবেশে থেকে যায়।'

যথাযথভাবে নিষ্কাশন না করলে আত্মরক্ষার উপকরণগুলো বিপদের কারণ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দীন।

তিনি বলেন, 'রাস্তাঘাটে মাস্ক-গস্নাভস ফেলে রাখছি, ফলে ঝুঁকি থেকেই যায়। এগুলো জীবাণুমুক্ত না করে ফেললে জীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে।'

সুরক্ষা সামগ্রীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সাথে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান।

তিনি বলেন, 'এই বর্জ্যগুলো আলাদা সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে আমাদের। জাইকার সাথে এ বিষয়ে কাজ করছি আমরা। দ্রম্নত এটি শুরুর চেষ্টা করছি আমরা। এখন মন্ত্রণালয়ে আছে বিষয়টি।'

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর বদরুল আমিন বলেন, 'এই কয়েক মাসে যে পরিমাণে এসব বর্জ্য জমা হয়েছে, সেসব তো আমরা আলাদা করতে পারছি না। এখন আমরা আলাদা কনটেইনার করার চেষ্টা করছি। আলাদাভাবে বর্জ্যগুলো এলে ডাম্পিং স্টেশন বা ল্যান্ডফিলে পোড়ানো যাবে।

'এটি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কোন বর্জ্যটা সংক্রমিত সেটা আমরা জানি না। বাসায় বাসায় সেগুলো আলাদা ব্যাগে রাখতে বলব। সেজন্য মাইকিং করব ও লিফলেটের মাধ্যমে প্রচারণা চালাব। আমাদের ৩৫০টি বর্জ্য ফেলার কনটেইনার আছে। চিন্তা করছি সেগুলোর পাশে ৫০টি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৫০টি আলাদা কনটেইনার রাখার।'

তবে এ কাজে সময় লাগবে এবং মানুষকেও সচেতন করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'যত দ্রম্নত সম্ভব আমরা এটি করব। প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তবে অনুমোদন ও বাজেটেরও বিষয় আছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101464 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1