শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সামুদ্রিক উৎস ব্যবহারে

অধের্ক খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা

পরিবেশ বঁাচবে ভয়াবহ দূষণের হাত থেকে সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে সৃষ্টি হবে বিপুল কমর্সংস্থান সুনিল অথর্নীতির বহুবিধ ব্যবহার বাড়বে
ওবায়দুর রহমান
  ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

দেশের ক্রমবধর্মান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে বিশাল সমুদ্র বক্ষ। নতুন এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অধেের্ক নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। সমুদ্রের ঢেউ, জোয়ারের স্রোত, বাতাস এবং সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। যা এক দিকে যেমন খরচ কমাবে, অন্যদিকে পরিবেশকে বঁাচাবে ভয়াবহ দূষণের হাত থেকে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বতর্মানে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৬৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ আসছে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে আগামী কয়েক বছরে শেষ হবে গ্যাসের মজুদ। তরল জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আটগুণ পযর্ন্ত অথর্ ব্যয় হয়। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলক ব্যয়বহুল। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিধার্রণ করা হয়েছে। তবে জমির স্বল্পতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস সৌরশক্তি ব্যবহার কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশাল সমুদ্র বক্ষ হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যা সমাধানের অন্যতম প্রধান উৎস।

সামুদ্রিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে ওসান থামার্ল এনাজির্ কনভারসেশন (ওটিএসি) নামে পরিচিতি। সামুদ্রিক উৎস থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তাতে কোনো ধরনের তেল, কয়লা অথবা গ্যাসের প্রয়োজন হয় না। যার কারণে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড নিগর্মন থাকে শূণ্যের কোঠায়। ফলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বঁাচবে দেশ । এই পদ্ধতি যে কোনো সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অধেের্ক নামিয়ে আনতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী গত ২০১৭ সালে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ছিল ২.৮৭ শতাংশ, যা এর আগের বছরে ছিল ২.৮৫ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করেছে সরকার। সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে অনায়াসে এই লক্ষ্যমাত্রা অজর্ন করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের উপক‚লবতীর্ অঞ্চলের বায়ু শক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপাটের্মন্ট অব এনাজির্র জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণাগারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটিও এর মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরিশাল এবং চট্টগ্রামের উপক‚লীয় এলাকায় প্রতি সেকেন্ডে বাতাসের গতিবেগ ৫.৭৫-৫-৭.৭৫ মিটার এমন উপকূলীয় এলাকা ২০ হাজার বগর্ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। যা দিয়ে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

এদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় উৎস হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ। বাংলাদেশে ছোট আকারের সৌর বিদ্যুৎ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। তবে বড় পরিসরে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম বঁাধা জমি। ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে ফেনীর সোনাগাজীতে অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় এক হাজার একর জমি। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম এ উৎস ব্যবহারে বড় চ্যালেঞ্জ বা বাধা মোকাবেলায় বড় আশার আলো হতে পারে ভাসমান সোলার প্যানেল। এক গবেষণায় এমন দাবি করেছে সিঙ্গাপুরের সৌর জ্বালানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বব্যাংক। ডেনমাকের্র জ্বালানি খাত ব্যবস্থাপনা সহায়তা কমর্সূচির অথার্য়নে পরিচালিত গবেষণার সারসংক্ষেপ স¤প্রতি প্রকাশ হয়েছে। যেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনির্য়ায় ১৭৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ভাসমান প্রযুক্তির। বতর্মানে চীনের এক কেন্দ্র থেকেই আসছে দেড়শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৪ লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ২০১৪ সাল থেকে বতর্মান সময় পযর্ন্ত ভাসমান সৌর প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০০ গুণ।

সুমইসোল নামের আন্তজাির্তক একটি সোলার সিস্টেম কোম্পানি জানিয়েছে, একই ভৌগোলিক অবস্থানে ছাদের ওপর নিমির্ত সোলার সিস্টেমের চাইতে সাগরে নিমির্ত সোলার সিস্টেম ৫-১০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এটা হয় পানির থেকে নিগর্ত ঠাÐা পরিবেশ এবং সূযের্র আলোর নিরবচ্ছিন্ন প্রতিফলনের জন্য।

এদিকে, জাতীসংঘের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সবুজ শক্তি উৎপাদনে প্রায় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। এই খাতে সৃষ্টি হবে মিলিয়নের বেশি কমর্সংস্থান। সূত্র জানায়, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক ঢেউ ও জোয়ারের স্রোত ব্যবহার করে ৩৩৭ জিওয়াট (গিগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। একই সময়ে ৩২০ জিওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে এবং ৪০০ জিওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সৌর শক্তি ব্যবহার করে। চীন, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যথাক্রমে ১০০ জিওয়াট, ২৫ জিওয়াট এবং ১১০ জিওয়াট সামুদ্রিক শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। বতর্মানে বিশ্বব্যাপী বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতি বছর ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে বাংলাদেশের এ খাতে অপার সম্ভাবনা থাকলেও যথেষ্ট নীতি সহায়তা এবং বিনিয়োগের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। খেঁাজ নিয়ে যানা গেছে, টেকনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসডিএন বিএইচডি নামের মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানি দক্ষিণ চট্টগ্রামে সামুদ্রিক ঢেউভিত্তিক একটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ পযর্ন্ত সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। কোম্পানির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এটি একটি সবুজ উদ্যোগ, সব ধরনের দূষণমুক্ত এবং পরিবেশ দূষণকারী কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড কমাবে। এই প্লান্টের প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৯০০ মিলিয়ন কিলোওয়াট।

জানতে চাইলে সমুদ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. কাউসার আহমেদ বলেন, সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশের তুলনায় এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। বøু ইকোনোমি বা সুনিল অথর্নীতির কেন্দ্র হতে পারে সমুদ্র শক্তি। সমুদ্র শক্তি ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদন প্রচলিত জ্বালানি উৎপাদনের চাইতে কম পরিবেশ দূষণ করবে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচও অধেের্ক নামিয়ে আনবে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আশা দরকার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ভিজিটিং লেকচারার সমুদ্রবিজ্ঞানী হাসিবুল ইসলাম বলেন, পযার্প্ত জমি না থাকায় বাংলাদেশে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় বড় আশার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে দেশের বিশাল সমুদ্রসীমা। বঙ্গোপসাগরে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে আগামীতে দেশের বিদ্যুতের চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (স্রেডা) সদস্য যুগ্মসচিব সেলিমা জাহান যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। দুটি কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া ছাদে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৭টি ছাদের ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি হলেও, পরিমাণে বেশি উৎপাদন করতে পারলে প্রচলিত বিদ্যুতের চেয়ে অনেক কমে পাওয়া যাবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত এ বিদ্যুৎ।

সমুদ্র শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে উপক‚লীয় অঞ্চলের বাতাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে বাতাস ব্যবহার করে। ফলে আমরা বিশাল সমুদ্র বক্ষের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব। যদিও এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশে নতুন, যার কারণে সমস্যা হচ্ছে। তবে একবার শুরু হয়ে গেলে এখাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<29926 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1