বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে জড়ানো একুশ

বিলস্নাল মাহমুদ মানিক
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
স্মৃতিতে জড়ানো একুশ

সকালে ঘুম থেকে জেগে মায়ের চোখে পানি দেখে অবাক হয়ে যায় রাতুল হাসান। সে চোখ কচলাতে কচলাতে মাকে জিজ্ঞেস করে- কী হয়েছে মা, কাঁদছো কেন? মা অশ্রম্নসিক্ত চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাতুলের দিকে, কিছুই বলে না। মায়ের নীরবতা ছোট্ট রাতুলকে বেশ ভাবনায় ফেলে দেয়। অনেকক্ষণ মায়ের পাশে বিছানায় বসে থাকে সে। একটু পরে রাতুলের বাবা মুন্তাসির হাসান সাহেব প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে বাসায় ফিরলে রাতুল জিজ্ঞেস করে- বাবা, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি মা কাঁদছে। মা কেন কাঁদছে, এ ব্যাপারে তোমার কিছু জানা আছে? আধোআধো কণ্ঠে রাতুল এ প্রশ্ন করতেই হাসান সাহেবের মনে পড়ে যায় আজ ২০ ফেব্রম্নয়ারি। ১৯৫২ সালের আজকের দিনে তার বড় ছেলে জোবায়ের হাসান রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করতে ঢাকা শহরে যাওয়ার সময় পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। তাই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেলে কলেজের পাশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে মিছিল হয়েছিল তাতে জোবায়ের হাসানের যোগ দেওয়া হয়নি। মুন্তাসির হাসান বুঝতে পারেন সেই স্মৃতি মনে করে তার স্ত্রী তাহমিনা হাসান কাঁদছেন। প্রতি বছর এই দিনটি এলে তার স্ত্রী একটানা তিন দিন মন খারাপ করে থাকেন, অনবরত কান্নাকাটি করেন এবং কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না। চার বছর বয়সি রাতুল হাসান এখনো জানে না এই স্মরণীয় ঘটনাটির কথা। বাবার চোখেও পানি দেখে রাতুলের ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেন তার মা ও বাবা দুইজনেরই আজ মন খারাপ। বাধ্য হয়ে সে তার বাবাকে আবারও প্রশ্ন করে- বাবা, তোমারও দেখি মন খারাপ হয়ে গেল। কী হয়েছে তা আমাকে বলা যায় না, বাবা? ছেলের এমন আবদারে আর চুপ থাকতে পারেননি মুন্তাসির হাসান সাহেব।

তিনি বলতে শুরু করেন- ঠিক আছে, শোনো তাহলে কেন আজ আমাদের মন খারাপ। তখন ১৯৫২ সাল। তোমার বড় ভাই জোবায়ের হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল সে, ক্লাশে সব সময় ফার্স্ট হতো। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধূলাতেও ছিল তার সমান দক্ষতা। ওই সময় পাকিস্তানিরা চেয়েছিল এ দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক। রাতুল বলে- পাকিস্তানি কারা বাবা? মুন্তাসির সাহেব বলেন, তখন আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ ছিল না। এ দেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর এখন পাকিস্তান নামে যে দেশ আছে সেটির নাম ছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তান। বড় হয়ে তুমি সব জানতে পারবে রাতুল। এখন তুমি মনোযোগ দিয়ে শোনো। রাতুল বলে আচ্ছা বাবা।

\হমুন্তাসির সাহেব আবারও বলতে শুরু করেন- পাকিস্তানিদের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালিরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করে। আসলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজধানী ছিল ঢাকায়।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি তা চরম আকার ধারণ করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন থামাতে দেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেই ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলার দামাল ছেলেরা। তোমার আম্মার অসুস্থতার খবর পেয়ে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি জোবায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এসেছিল। ২০ ফেব্রম্নয়ারি তার এক বন্ধু টেলিফোন করে জানালো যে, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল হবে। এ দেশের শত শত বাংলাভাষাপ্রেমী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পাকিস্তানি দোসর পুলিশেরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে বরকত, জব্বার, রফিক, সালামসহ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রম্নয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ২২ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউলস্নাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রম্নয়ারি বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিকে অম্স্নান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। শহীদ মিনারটি ২৪ ফেব্রম্নয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এবং ২৬ ফেব্রম্নয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। একুশে ফেব্রম্নয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রম্নয়ারি। এখন প্রতি বছর ২১ ফেব্রম্নয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বড় হয়ে তুমি বিস্তারিতভাবে সব জানতে পারবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে