শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক চরিত্রে সফল যারা

ম মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আনোয়ারা বেগম

দেশীয় চলচ্চিত্রে এখন নতুন একটা ট্রেন্ড বা ঝোঁক চলছে। সেটা হলো ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' জীবনীমূলক পস্নট নিয়ে সিনেমা বানানো। দেশীয় চলচ্চিত্রে এটা সুবাতাস বয়ে আনবে বলে অনেকেই আশা করছেন। ঐতিহাসিক পস্নট নিয়ে সিনেমা বানানো নতুন নয়। ঢাকাই সিনেমার সোনালি যুগেও হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।

'রূপবান' সিনেমাটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা দেখেই হিড়িক পড়ে একই ধারার সিনেমা বানানো। এ সময়েই ১৯৬৭ সালে ঐতিহাসিক পস্নট নিয়ে বানানো 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' দর্শক দারুণভাবে লুফে নেন। উৎসাহিত হয়ে পরের বছরই 'সিগনিফিকেন্ট' চরিত্র নিয়ে ইবনে মিজান বানান, 'শহীদ তিতুমীর'।

প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল দেখতে নতুনধারা সৃষ্টির দরকার আছে। এটার বিপদও আছে। অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে দর্শকই এক সময়ে বিরক্ত হয়ে প্রেক্ষাগৃহ ছাড়তে পারে। এখন ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' জীবনীমূলক যেসব সিনেমা হচ্ছে বেশির ভাগই সরকারি অনুদানে। বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। 'সিগনিফিকেন্ট' চরিত্রের ওপর হচ্ছে 'প্রীতিলতা', 'তিতুমীর' প্রভৃতি। ঐতিহাসিক পস্নটের ওপর এ পর্যন্ত যত সিনেমা হয়েছে ব্যবসায়িকভাবে সবচেয়ে বেশি সফল 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। কেন্দ্রীয় চরিত্রে কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। এই একটি সিনেমাতে অভিনয় করেই চিরকালের জন্য মুকুটবিহীন সম্রাট হয়ে আছেন। অন্যদিকে 'আলেয়া' চরিত্রে আনোয়ারার অভিনয় আজও দেশের চলচ্চিত্রে অদ্বিতীয় হয়ে আছে। ষাট ও সত্তর দশকে বানানো ঐতিহাসিক ও 'সিগনিফিকেন্ট' পটভূমিকায় আরো সিনেমা- 'শহীদ তিতুমীর', 'রাজা সন্নাসী', 'ভাওয়াল সন্নাসী', 'গাজী কালু চম্পাবতী', 'বাহরাম বাদশাহ', 'নিমাই সন্যাসী', 'লালন ফকির', 'ঈশা খাঁ' প্রভৃতি। তবে তখন এসব ছবি বিচ্ছিন্নভাবে বানানো হয়।

কিন্তু সম্প্রতি এটা একটা ঝোঁক হিসেবে এসেছে। আমাদের অনেক ঐতিহাসিক গল্প বা জীবনীমূলক কাহিনি রয়েছে। এগুলো সিনেমায় রূপ দিলে ভালো হবে বলে অনেকেই মনে করেন। তবে তারা এটাও মনে করেন, দেশের মানুষ এগুলোর সঙ্গে বংশপরম্পরায় পরিচিত, কাজেই এটা নির্মাতাদের দায়বদ্ধতা নিয়েই বানাতে হবে। কারণ, দেখা গেছে, ঐতিহাসিক বা জীবনীমূলক সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের তুলনায় বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতা-চরিত্রাভিনেত্রীরাই ভালো করছেন। প্রকৃষ্ট উদাহরণ আনোয়ার হোসেন ও আনোয়ারা। যারা জনপ্রিয় এবং শুধু 'নায়ক-নায়িকা' হিসেবেই পারফর্ম করেন, কিন্তু পাশাপাশি চরিত্রাভিনয় করেন না- তারা এই চ্যালেঞ্জে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসফল হন। এর কারণ হয়তো তাদের মাথায় নিজেদের অগুণতি দর্শকের চিন্তা প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। তখন এ ধরনের চরিত্রে সেই চাপটা নিতে ব্যর্থ হন। 'ওভার অ্যাকটিং' করে ফেলেন। তবে এটা নির্মাতার নির্দেশনাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কীভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, অভিনেতার কাছ থেকে কী রকম পারফর্ম চাচ্ছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের তারকা 'নায়ক' বাপ্পী চৌধুরী বলেন, 'সারাদেশের মানুষই আমাকে 'নায়ক' হিসেবে চিনে। শাকিবকে চিনে, আরিফিন শুভকে চিনে। বিষয়টা আমাদের মাথায় থাকে। না জানি কেমন হয়, এমন একটা মানসিক চাপ থাকে।' অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে নির্মাতার নির্দেশনাতে চরিত্রাভিনেতারা অনেকটা নির্ভার থাকেন। চাপমুক্ত স্বাধীনভাবে অভিনয় করতে পারেন। জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকারা ব্যবহৃত হন শুধু ব্যবসায়ের জন্যই। এখন কোনো ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' সিনেমা শুধু ব্যবসায়িক লক্ষ্যেই বানালে নির্মাতা সে রকম অভিনেতা-অভিনেত্রীই চাইবেন। ব্যবসায়ের জন্যই সব সিনেমা বানানো হয়। তবে ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' সিনেমা শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যই নয়- তাতে একটা দায়বদ্ধতাও থাকা দরকার। কারণ, এগুলোর সঙ্গে দর্শক শুধু জন্ম থেকেই নয়, বংশপরম্পরায়ও পরিচিত। তখন পান থেকে চুন খসলেই বিপদ।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, 'এক্ষেত্রে আমি বুঝি ভালো অভিনেতা এবং খারাপ অভিনেতা। সেক্ষেত্রে পরিচালকের ওপর নির্ভর করে তিনি কি বানাচ্ছেন, কীভাবে বানাবেন। তিনিই ঠিক করবেন সেখানে কোন চরিত্রে কাকে যোগ্য মনে করবেন। আর এটা কি সবসময়েই হয়? কখনো পপুলার নায়কও তো ভালো করেন। এক্ষেত্রে নির্মাতা চরিত্র অনুযায়ী যাকে মানানসই মনে করবেন তাকেই নেবেন। আমি এটাই বুঝি।' তাহলে এ ধরনের চলচ্চিত্রে এমনকি সামাজিক চলচ্চিত্রেও জনপ্রিয় তারকাদের তুলনায় চরিত্রাভিনেতারাই কেন সবচেয়ে বেশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার লাভ করছেন? সে তুলনায় জনপ্রিয় এবং শুধু নায়ক-নায়িকা হিসেবে পারফর্ম করা অভিনেতারা কেন পিছিয়ে? অনেকে দু'চার শত সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা থাকলেও এক্ষেত্রে কেন ব্যর্থ হচ্ছেন? সফল হলে কিন্তু বড় পুরস্কারের স্বীকৃতি মিলত। অথচ চরিত্রাভিনেতারা ১০-২০টি সিনেমা করার অভিজ্ঞতাতেই একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরও অন্যান্য অনেক পুরস্কার পাচ্ছেন। সন্দেহ নেই এতে নির্দেশকের কৃতিত্বই বেশি। কারণ, গল্প অনুযায়ী তিনি সঠিক চরিত্র নির্বাচন করতে পেরেছেন। এরকম অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন, রাইসুল ইসলাম আসাদ। অভিনয় করেছেন ২২টি চলচ্চিত্রে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ৬ বার। এ ছাড়া তারিক আনাম খান সিনেমা করেছেন ২৪টি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে ২ বার। বুলবুল আহমেদ তার সময়ে যতটা না জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতাই। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে ৪ বার। এ টি এম শামসুজ্জামান (৬ বার), আনোয়ার হোসেন (২ বার), আনোয়ারা (৮ বার), হুমায়ুন ফরিদী (১ বার) চঞ্চল চৌধুরী (২ বার), জাহিদ হাসান (১ বার), আরমান পারভেজ মুরাদ (১ বার)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে