শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে কিছুক্ষণ

রাইসুল ইসলাম আসাদ শুধু একজন চলচ্চিত্রযোদ্ধাই নন, রণাঙ্গনের 'গেরিলা যোদ্ধা' হিসেবে দেশের স্বাধীনতায় সরাসরি অবদান রেখেছেন। এখন চলছে বিজয়ের মাস। বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই গেরিলাযুদ্ধসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে তারার মেলার পক্ষ থেকে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমেই জানান, এ বিষয়ে কোনো কথাই বলবেন না। এর পর বললেন, 'আপনার আগে গত কয়দিনে কমপক্ষে ৩০টি মিডিয়া থেকে আমাকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছে। কিন্তু আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাইনি।' কিছুটা অনুযোগের সুরে বললেন, 'কেনই বা বলবো, এর আগে আপনারা কোথায় ছিলেন? বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস এলেই আমাদের স্মরণ করেন। যুদ্ধ কী আমি একাই করেছি? আরো তো আড়াই লাখ গেরিলা যোদ্ধা ছিল।'
ম মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

বরেণ্য অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছোটপর্দা-বড়পর্দায় সমান দাপুটে অভিনয়ের জন্য অত্যন্ত সুবিদিত। এ জন্য তার নামের আগে ও পরে 'সুপারস্টার', 'ড্যাশিং হিরো', 'মহানায়ক', 'নায়ক রাজ', 'রাজকুমার'- এই জাতীয় বিশেষ উপাধি নেই। তবে গুণী অভিনেতা হতে যা যা লাগে কোনোটিরই কমতি নেই। বরং জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ে যে সমস্ত গুণ থাকতে হয় সে রকম অনেক ডাকসাইট অভিনেতারও নেই। এ শিল্পীর প্রধান গুণ চরিত্রের সঙ্গে একেবারে চরিত্রানুগ মিশে যাওয়া। এ জন্যই তুলনায় অত্যন্ত কম (২২টি) সিনেমায় অভিনয় করেও এ পর্যন্ত ছয়-ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। পেয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার 'একুশে পদক'ও।

রাইসুল ইসলাম আসাদ শুধু একজন চলচ্চিত্রযোদ্ধাই নন, তার আরও পরিচয় আছে। তিনি সম্মুখ রণাঙ্গনের 'গেরিলা যোদ্ধা'। দেশের স্বাধীনতায় সরাসরি অবদান রেখেছেন। এখন চলছে বিজয়ের মাস। বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও সেই গেরিলাযুদ্ধসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে যায়যায়দিনের তারার মেলার পক্ষ থেকে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সে বিষয়ে কোনো কথাই বলবেন না জানিয়ে বলেন, 'আপনার আগে গত কয়দিনে কমপক্ষে ৩০টি মিডিয়া থেকে আমাকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছে। কিন্তু আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাইনি।' কিছুটা অনুযোগের সুরে বললেন, 'কেনই বা বলবো, এর আগে আপনারা কোথায় ছিলেন? বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস এলেই আমাদের স্মরণ করেন। যুদ্ধ কী আমি একাই করেছি? আরো তো আড়াই লাখ গেরিলা যোদ্ধা ছিল।'

এই বক্তব্যেই এ অভিনেতার মনের ক্ষোভটিও যেন ধরা দিল। সব মিলিয়ে তার অর্জন যে কোনো শিল্পীর জন্যই অত্যন্ত ঈর্ষা জাগানিয়া। কিন্তু সবার মতো এ অভিনেতারও ব্যক্তিগত জীবন আছে। যেমন আছে এখনো বেঁচে থাকা আরো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধারও। তাদের কি সেভাবে খোঁজ নেওয়া হয়? তারাও 'বাংলাদেশ' নামে একটি রাষ্ট্রের পরিচয় দিতে সম্মুখ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। শহীদ হয়েছেন অসংখ্য। তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে। তাদের খোঁজ থাকে না- কারণ, তাদের বিশিষ্ট কোনো পরিচয় নেই। তাতেই বোঝা গেছে, এ অভিনেতার মনের অভিব্যক্তি। তখন যোগ করা হয়- আমি মাস দুয়েক আগেও আপনার সঙ্গে কথা বলেছি- 'তা ঠিক আছে। এ সম্পর্কে আমি অনেক জায়গায় অনেক কথা বলেছি। সেখান থেকে জেনে নেবেন।' রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন। মাস দুয়েক আগে এই বরেণ্য অভিনেতার নতুন কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেছিলেন- 'গত দু'বছর যাবত কোনো কাজই করছি না। খাই-দাই ঘুরি-ফিরি এই তো'। তবে চলতি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া তার অভিনীত 'মিশন এক্সট্রিম' সিনেমায় তিনি থাকলেও যতটুকু দেখা দেন, তাতে তাকে চেনাই যায় না। বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই বলেন, 'ওটা নিয়ে একদমই কিছু বলতে চাই না। দয়া করে কিছু লিখবেনও না এ নিয়ে।'

এ নিয়ে লিখতে বারণ করার কারণও আছে। তিনি আগে যত সিনেমায় অভিনয় করেছেন সবগুলোই সমাজ-জীবনঘনিষ্ঠ ও মননশীলধর্মী। পছন্দ না হওয়াতেই একসময়কার পোশাকি-ফ্যান্টাসি সিনেমার কোনোটিতে অভিনয় করেননি। এমন ইমেজ থাকতেও 'মিশন এক্সট্রিম', 'অপারেশন সুন্দরবন' কেন করলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি আবারও যোগ করেন- "আমি সবসময় বিনোদন করেছি। তাই সব রকমই অভিনয় করেছি। আমি একই সঙ্গে 'ঘুড্ডি' ও 'লাল সবুজের পালা' করেছি। একটিতে হিরো আরেকটিতে ভিলেন। কাজেই যে চরিত্র পছন্দ করেছি সে চরিত্রে অভিনয় করেছি। এ হলো সোজা বাংলা কথা। তবে আগের অ্যাকশন ছবির চরিত্র পছন্দ হয়নি তাই করিনি। পরে সম্পর্কের খাতিরেই 'মিশন এক্সট্রিম', 'অপারেশন সুন্দরবন'- এগুলোতে অভিনয় করেছি। অনেক জোরাজুরি করাতেই 'না' করতে পারিনি। বলেন তো, এটা কি বলার মতো আমার পছন্দের চরিত্র? 'খালি গেলাম আর মইরা গেলাম'- তারপরই খেইল খতম। এটা নিয়ে কোনো কথাই বলবেন না। এ নিয়ে বলার কিছুই নেই। এই ছবির ওপর কোনো ফিচার হতেই পারে না।" এরপর যোগ করেন, 'বলার মতো যদি হয় সেটা বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক। তারপরও রিলিজের আগে এ সম্পর্কেও এখন কিছু বলতে চাই না।'

এখন এ অভিনেতাকে আবার পর্দায় দেখা গেলেও কাজগুলো দুই বছর আগের বলে জানালেন। করোনার আগে থেকেই নতুন কাজ করছেন না জানিয়ে আবারও বলেন, "এখন আমি কোনো কাজই করছি না। সম্প্রতি আরটিভিতে প্রচার শুরু হয়েছে আমার নতুন ধারাবাহিক নাটক 'ফাইফ স্টার মেস'। এটাও করোনার অনেক আগে করেছি।"

তার মানে রাইসুল ইসলাম আসাদের মতো অভিনেতাও কারো কোনো ছবি বা নাটকেই নেই এখন। সেই ক্ষোভেই কী এ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে চান না! অথচ এই অভিনেতা ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে 'ক্র্যাক পস্নাটুনে'র সদস্য ছিলেন। তখন অভিনয় প্রসঙ্গ পাশকাটিয়ে তার সেই গেরিলা যুদ্ধের রোমাঞ্চকর স্মৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে তাতেও কিছু বলবেন না বলে জানান। এ অবস্থায় একপ্রকার নাছোড়বান্দা হয়ে বলা হয়- এটাও তো ঠিক যে, আপনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে হওয়া 'একুশে পদক' পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে 'স্বাধীনতা পদক' পেলে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ মিলে সেটাও পরিপূরক হয়ে যায়। কি বলেন, এমন কথায় সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গটি কেড়ে নিয়ে বলেন, 'কে বলেছে, সেটা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে হওয়া পদক? আমি তো তখন জন্মাইওনি। 'স্বাধীনতা পদক'ও স্বাধীনতার জন্য নয়। বেসামরিক দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ পদক 'একুশে পদক'। সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক, 'স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার'। এগুলোর কোনোটাই ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতার জন্য নয়। এগুলো সরকারিভাবে দেওয়া পুরস্কারের দুটো ধাপ। ভারতেও এরকম কয়েকটি ধাপ আছে। যেমন, সর্বোচ্চ অসামরিক পদক, 'ভারতরত্ন', তারপরে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা, 'পরম বীরচক্র', তারপরে 'অশোক চক্র'- এটা 'পরমবীর চক্রে'র সমতুল্য। এরপরে 'পদ্মবিভূষণ', 'পদ্মভূষণ', 'পদ্মশ্রী' ইত্যাদি। এগুলো বিশেষ বিশেষ কৃতিত্ব অনুযায়ী দেওয়া হয়। আমাদের এখানেও তাই। 'একুশে পদক', 'স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার'ও তাই। কাজেই 'একুশে পদক' ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে, 'স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার' স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য হয়েছে- এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন (হাসতে, হাসতে)।

এই হাসির মধ্যেই জানতে চাওয়া হয়- কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন না হলে- এর জন্য কেউ শহীদ না হলে এই পুরস্কারটি প্রবর্তন করা হতো? কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ না হলে? 'সেটা তো অন্য হিসাব। তবে আমাকে 'একুশে পদক' দেওয়ায় খুশি হয়েছি। আনন্দিত হয়েছি। এখন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে যে রকম যোগ্যতা দরকার আমাকে সেরকম মনে করলে দেবেন। না হলে দেবেন না। এটা যদি স্বাধীনতার জন্য প্রবর্তন হতো তাহলে যে আড়াই লাখ যুদ্ধ করেছেন সবাইকেই এটা দিতে হতো।' বললেন রাইসুল ইসলাম আসাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে