রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ফিলিস্তিন সংকট

তরমুজ যেখানে আন্দোলনের প্রতীক

তরমুজকে রূপক হিসেবে ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর, ইসরাইল যখন গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, তখন তারা দখলকৃত অঞ্চলগুলোয় ফিলিস্তিনি পতাকা এবং এর রঙের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে, এমন প্রতীক বহন নিষিদ্ধ করে। পতাকা বহন করা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়, ফিলিস্তিনিরা এ কারণে প্রতিবাদস্বরূপ তরমুজের টুকরা ব্যবহার করতে শুরু করে...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
প্রতিবাদ হিসেবে তরমুজ ব্যবহারের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস

'ফিলিস্তিনে যেখানে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো অপরাধ, সেখানে ফিলিস্তিনের লাল, কালো, সাদা, সবুজ রং প্রদর্শনে ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে অর্ধেক কাটা তরমুজ তুলে ধরা হয়।' এই কবিতার লাইনগুলো 'ওড টু দ্য ওয়াটারমেলন' থেকে নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি লিখেছেন আমেরিকান কবি অ্যারাসেলিস গিরমে। এই কবিতায় ফিলিস্তিনকে বোঝাতে এই ফলটিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়।

লাল, কালো, সাদা এবং সবুজ শুধু তরমুজ নয়, ফিলিস্তিনের পতাকারও রং। এ কারণে গাজায় ইসরাইলের সর্বশেষ আগ্রাসনের মধ্যে ফিলিস্তিনিপন্থি মিছিলে এবং অগণিত সোস্যাল মিডিয়া পোস্টে এই প্রতীকটি বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

কিন্তু তরমুজকে রূপক হিসেবে ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর, ইসরাইল যখন গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, তখন তারা দখলকৃত অঞ্চলগুলোয় ফিলিস্তিনি পতাকা এবং এর রঙের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে, এমন প্রতীক বহন নিষিদ্ধ করে। পতাকা বহন করা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়, ফিলিস্তিনিরা এ কারণে প্রতিবাদস্বরূপ তরমুজের টুকরা ব্যবহার করতে শুরু করে।

১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কয়েকটি ধারাবাহিক অন্তর্র্বর্তী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়, যা 'অসলো চুক্তি' নামে পরিচিত।

লাল, কালো, সাদা ও সবুজ রঙের পতাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পতাকা হিসেবে স্বীকৃত ছিল, যা গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পরিপ্রেক্ষিতে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'র সাংবাদিক জন কিফনার তার প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছিলেন, 'একবার গাজা উপত্যকায় কাটা তরমুজ বহন করার জন্য কয়েকজন যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল- কারণ এভাবে ফিলিস্তিনি পতাকার লাল, কালো ও সবুজ রংগুলো প্রদর্শন করা হয়েছিল। ইসরাইলি সেনারা একসময় মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকত এবং মিছিলে কেউ এ সময়কার এই নিষিদ্ধ পতাকা ওড়ালেই তা কেড়ে নেয়া হতো!'

বেশ কয়েক মাস পরে, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে পত্রিকাটি জানায়, ওই প্রতিবেদনে যুবকদের তরমুজ বহনের জন্য যে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করা যায়নি। সেই সঙ্গে এটাও বলা হয়, একজন ইসরাইলি সরকারের মুখপাত্রের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না, এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

চিত্রকর্মে তরমুজ

তারপর থেকে শিল্পীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে তরমুজের বৈশিষ্ট্যযুক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করতে থাকেন। এর মধ্যে খালেদ হুরানির শিল্পকর্মটি সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর একটি। ২০০৭ সালে তিনি 'সাবজেক্টিভ অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন' শিরোনামে একটি বইয়ের জন্য তরমুজের টুকরার ছবি এঁকেছিলেন। 'দ্য স্টোরি অফ দ্য ওয়াটারমেলন' নামে অভিহিত পেইন্টিংটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়। এবং ২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইল-হামাস সংঘর্ষের সময় থেকে এই ছবিটি আরও পরিচিত হয়ে ওঠে।

চলতি বছরের শুরুতে তরমুজের চিত্রায়নে আরেকটি আরেকটি জোয়ার দেখা দেয়। জানুয়ারিতে, ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গভির পুলিশকে পাবলিক স্পেস বা জনবহুল স্থল থেকে ফিলিস্তিনি পতাকা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই পতাকা ওড়ানো মানে 'সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করার' মতো কাজ। তখন ইসরাইল বিরোধী মিছিলে তরমুজের ছবি ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেটওয়ার্কে

ইসরাইলি আইন ফিলিস্তিনি পতাকাকে বেআইনি ঘোষণা করেনি। তবে পুলিশ ও সেনাদের অধিকার দেওয়া হয়েছে, কোনো ক্ষেত্রে তারা যদি মনে করে, এটি জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি, তাহলে তারা ওই পতাকা সরিয়ে ফেলতে পারবে।

জুলাই মাসে জেরুজালেমে এক বিক্ষোভে, ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে একটি তরমুজ ধরে প্রতিবাদ করে, যার ওপর লেখা ছিল 'স্বাধীনতা' শব্দটি।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিচারিক সংস্কার পরিকল্পনার প্রতিবাদে আগস্টে তেল আবিবে বহু মানুষ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে জড়ো হওয়ার সময় কয়েকজন বিক্ষোভকারী তরমুজের ছবিযুক্ত টি-শার্ট পরেছিলেন। অতি সম্প্রতি, গাজা সংঘাতের প্রতিবাদে সোস্যাল মিডিয়া পোস্টে তরমুজ এবং এর ছবি ব্যবহার করতে দেখা যায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ মুসলিম কৌতুক অভিনেতা শুমিরুন নেসা টিকটকে তরমুজের ফিল্টার তৈরি করেন এবং তার ফলোয়ারদের উৎসাহিত করেন- তারা যেন তাদের ভিডিও তৈরি করতে এই ফিল্টারটি ব্যবহার করেন। তিনি প্রতিশ্রম্নতি দেন এ থেকে যে আয় হবে, তার সব অর্থ গাজাকে সাহায্যকারী দাতব্য সংস্থাকে দেওয়া হবে।

কিছু সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ফিলিস্তিনি পতাকার পরিবর্তে তরমুজ পোস্ট করছেন এই ভয়ে যে, তরমুজের পরিবর্তে পতাকা ব্যবহার করলে তাদের অ্যাকাউন্ট বা ভিডিওগুলো হয়তো এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেটওয়ার্কগুলো দমন করতে পারে। সহজ করে বললে, তাদের কন্টেন্টের রিচ কমিয়ে ফেলা হতে পারে।

ফিলিস্তিনপন্থি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা অতীতে ইনস্টাগ্রামের বিরুদ্ধে 'শ্যাডো ব্যানিং'র অভিযোগ এনেছিল। শ্যাডো ব্যানিং হলো, যখন কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইট বা অনলাইন ফোরাম তাদের একজন ব্যবহারকারীকে তার অজান্তেই বস্নক করে দেয়। এর ফলে সাধারণত তাদের পোস্ট এবং মন্তব্যগুলো অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে আর দৃশ্যমান হয় না। এক কথায় ওই পস্ন্যাটফর্মটি নিশ্চিত করে, ওই ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট কিছু পোস্ট অন্যদের ফিডে প্রদর্শিত হবে না।

কিন্তু বিবিসির সাইবার প্রতিবেদক জো টিডি বলেছেন, এখন যে এমনটা ঘটছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনপন্থি কন্টেন্ট পোস্ট করা ইউজারদের শ্যাডো ব্যান করার কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ সোস্যাল মিডিয়া পোস্টে তরমুজের ছবি ব্যবহার করছে, কিন্তু তারা অবাধে ফিলিস্তিনের পতাকাও ব্যবহার করছে এবং সংঘাত সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লিখছে।'

ফিলিস্তিনে কয়েক দশক ধরে তরমুজ একটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, বিশেষ করে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ) উভয় ক্ষেত্রেই। তরমুজ এখন শুধু ওই ভূখন্ডের অসম্ভব জনপ্রিয় খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং ফিলিস্তিনি প্রজন্মের জন্য এবং তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের সমর্থনকারীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে