শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালি চেতনার উজ্জ্বল সারথি কামাল লোহানী

নিরহঙ্কার ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন আলো ছড়ানো ব্যক্তিত্বের নাম কামাল লোহানী। তিনি আলো ছড়িয়েছেন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সমাজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো, সংস্কৃতির আলো। বাঙালির মানস গঠনেও তার ভূমিকা উজ্জ্বল। তিনি ছিলেন নীতি ও প্রজ্ঞার সাধক। তার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখবে।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২১ জুন ২০২০, ০০:০০

করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী। শনিবার ২০ জুন সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতাও ছিল তার। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তার মৃতু্যর মধ্যদিয়ে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হলো। আমরা হারালাম আমাদের অভিভাবককে।

এ দেশের সাংবাদিকতা, সংস্কৃতির ইতিহাসে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, নিজেই একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস বহন করে বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালি হৃদয়ে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন একুশের ও স্বাধীনতার চেতনা। যে চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। আজীবন সংগ্রামী কামাল লোহানী দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি সব সময় ছিলেন সামনের সারির অকুতভয় লড়াকু সৈনিক। চির বিদ্রোহের নাম কামাল লোহানী। এই বিদ্রোহ, সততা, নৈতিকতা ও চেতনার প্রশ্নে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

কামাল লোহানী সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাগতজীবন শুরু করলেও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সবসময়। এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি, দিয়েছেন সফল নেতৃত্ব।

কামাল লোহানী হিসেবে পরিচিত হলেও, তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে তার জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ভাষা আন্দোলনের বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি যুক্ত হন রাজনীতিতে। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। এরই মধ্যে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। যুক্ত হন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায়। নাচ ও গানের ব্যাপারে সমান মনোযোগী ছিলেন তিনি।

১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্‌ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পারিবারিক মতবিরোধ হওয়ায় ঢাকা চলে আসেন তিনি। চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ওই বছরই দৈনিক মিলস্নাত পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তার। একই বছর তিনি ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

ঢাকায় আসার পরেই নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মে কামাল লোহানীর। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির হয়ে কামাল লোহানী তার নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের 'নকশী কাঁথার মাঠ' প্রযোজনায় অংশ নেন। পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে তিনি যান। এরই ফাঁকে তিনি চাকরি করেন দৈনিক 'আজাদ', দৈনিক 'সংবাদ', 'পূর্বদেশে'। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার ছিল দৃঢ় ও আপসহীন ভূমিকা। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে 'শ্যামা' নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন।? ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী 'ছায়ানট'-এর সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন 'ক্রান্তি' নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বেতারের, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে মনোযোগী হন।?১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৭২ সালের ফেব্রম্নয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯২ সালে। আমিই তাকে দৈনিক আজকের কাগজে কলাম লিখতে উৎসাহিত করি। কাগজটি বন্ধ হওয়ার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭) আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে নিয়মিত লিখতেন। এরপর আমি ২০০৮ সালের জুলাই মাসে যায়যায়দিনে যোগ দানের পর থেকে তিনি নিয়মিত লিখতেন। তবে গত দুই বছর তিনি লেখালেখিতে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তার চোখে গস্নুকোমা ধরা গড়ে। শেষের দিকে তিনি চোখে দেখতেন না। ২০১৪ সালে আমার উদ্যোগে গড়ে ওঠে জাতীয় লেখক সাংবাদিক পরিষদ। এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন কামাল লোহানী। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এর বাইরেও তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য। এ ছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা ছিলেন।

তিনি সব সময় সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। অর্থবিত্তের প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। তিনি নীতির প্রশ্নে আমৃতু্য ছিলেন আপসহীন। লেখালেখি সংস্কৃতিচর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। যার কারণে তিনি মেয়ের বাসায় থাকতেন এবং তার কোনো গাড়িও ছিল না, যা এই সমাজে বিরল। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন- 'পাকিস্তান আমলে লবণের দাম বেড়েছিল, তখন গান লেখা হয়েছিল। কবিতা লেখা হয়েছিল। কিন্তু এখন নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে কোনো গান লেখা হয় না, কবিতা হয় না।'

কামাল লোহানীর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'আমরা হারবো না', 'সত্যি কথা বলতে কী', ' যেন ভুলে না যাই' 'মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার', 'রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার', 'মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার', 'এ দেশ আমার গর্ব', 'আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম', 'লড়াইয়ের গান', 'সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার', 'দ্রোহ প্রেমে কবিতার মত' এবং কবিতার বই 'শব্দের বিদ্রোহ'।

তিনি ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা, রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা, ক্রান্তি স্মারক, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, জাহানারা ইমাম পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ?

নিরহঙ্কার ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন আলো ছড়ানো ব্যক্তিত্বের নাম কামাল লোহানী। তিনি আলো ছড়িয়েছেন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সমাজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো, সংস্কৃতির আলো। বাঙালির মানস গঠনেও তার ভূমিকা উজ্জ্বল। তিনি ছিলেন নীতি ও প্রজ্ঞার সাধক। তার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখবে।

ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমে মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে ধ্রম্নবতারার মতো। তিনি সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করেছেন সবসময় এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মধ্যে। তার প্রজ্ঞার দৃষ্টি এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা সমাজে আলো ফেলেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে এমন কোনো আন্দোলন নেই যাতে তিনি সামনের সারিতে ছিলেন না।

মৌলবাদ-সাম্প্র্রদায়িকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দীর্ঘদিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তিনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন। মধ্যবিত্ত বাঙালির সংস্কৃতির আন্দোলনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ তিনি। দেশের প্রতিটি সংকটকালে তার লেখা, বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে।

দাম্ভিকতা ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতা কোনো নেতিবাচক দিকই তার জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন জাতির অভিভাবক, বিবেকের কণ্ঠস্বর, বাঙালি চেতনার উজ্জ্বল বাতিঘর। বহু অভিধায়ই তাকে অভিহিত করা যায়। সাংবাদিক প্রাবন্ধিক সমাজহিতৈষী, সমাজ-সংস্কৃতি বিকাশের পুরোধা কত কী। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি চেতনার উজ্জ্বল সারথী।

এ দেশের মুক্তি বুদ্ধিচর্চার বরেণ্য পথিকৃত তিনি। তিনি আমাদের সামনে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির নানা ক্রান্তিলগ্নে তাকে দেখা গেছে সামনের সারিতে। তিনি ছিলেন বহুমুখী এক বিরল প্রতিভা। তার শূন্যতার জায়গাটি শূন্যই থেকে যাবে কিনা এটা গভীর ভাবনার বিষয়। আমাদের সংস্কৃতির ভেতরের শক্তিগুলো তিনি আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, শনাক্ত করেছেন, এটা যদি আমরা সফলভাবে অনুসরণ করতে পারি তা হলে বাঙালি সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরও বিকশিত হবে অন্যদিকে আমরাও সমৃদ্ধ হবো।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<103223 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1