শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতি কেন বৈরী হয়ে উঠছে?

পরিবেশ সচেতনতার এ যুগে পরিবেশ দূষণবন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে। সেটা পাহাড় কাটা, কৃষি জমি রক্ষা, হাইটেক পার্ক, নদীদখল, সুন্দরবনরক্ষাসহ যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন
ড. হারুন রশীদ
  ১৩ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

চলছে তীব্র দাবদাহ। জনজীবন অতিষ্ঠ গরমে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের জন্য মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির ওপর নানাভাবেই খবরদারি করছে। খাল বিল নদীনালা দখল করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বানানো হচ্ছে সমতল ভূমি। কৃষি জমিও নষ্ট করা হচ্ছে ঘরবাড়ি বানিয়ে। নানাভাবেই চলছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার। যে কারণে বৈরী হয়ে উঠছে প্রকৃতি।

'আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই...' নজরুল তার গানে পাহাড় আর আকাশের মিতালীর এই উপমা ব্যবহার করেছিলেন। সেটা চট্টগ্রামের পাহাড়কে দেখেই। কিন্তু পাহাড়গুলোর আজ সত্যি হেলান দেওয়া অবস্থা। ভূমি খোকো মানুষজন পাহাড়ের শরীর কেটে কেটে এতটাই শীর্ণকায় করে ফেলেছে যে,পাহাড়গুলোর নিজেদের থেকে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। শুধু তাই নয়, একটু ঝড়-বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হচ্ছে। পাহাড়ের আলগা শরীর খসে পড়ছে। আর তাতে বছর বছর ঘটছে প্রাণহানি। দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। ফি বছর এ ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলেও কারও কোনো হুঁশ নেই। বরং লোভ ও লালসা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। সর্বগ্রাসী মানসিকতার কাছে হার মানছে আইন, কানুন ও মানবিকতা- সবই। ফলে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের।

আমাদের দেশে এমননিতেই সড়ক দুর্ঘটনা, বন্যা, মহামারিসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে লোকজনের অপমৃতু্যর ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের কারণে প্রকৃতিও যেন বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে প্রকৃতির মধ্যেও যেন দেখা দেয় প্রতিশোধ পরায়ণতা। আর একে প্রতিশোধ পরায়ণতাই বা বলি কী করে। পাহাড়ের ওপর থেকে গাছ কেটে, ট্রাকে ট্রাকে মাটি কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেললে বৃষ্টি-বাদলায় তার ধসে পড়া ছাড়া আর কী কোনো উপায় থাকে? আর পাহাড়ের ঢালুর নিচে যে সমস্ত অসহায় মানুষ বসতি স্থাপন করে তাদের মৃতু্যর মিছিল শুরু হয়। অকাতরে প্রাণ যায় এসব ভাগ্যাহত মানুষের। যারা সমতলে জায়গা না পেয়ে জীবনের অমোঘ টানে এই বিপজ্জনক জায়গাকেই বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও আশ্চর্যজনক হচ্ছে এই পাহাড়েরও মালিক আছে! এই তথাকথিত মালিকরাই পাহাড় কেটে মাটি লুট করে। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় অসহায় মানুষকে থাকতে বাধ্য করে। এদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় হয়। এতে রয়েছে মোটা অংকের বাণিজ্য। সরকার যাবে সরকার আসবে। কিন্তু পাহাড় দখলকারীদের গায়ে ফুলের টোকা পড়বে না। কারণ যারা দখল দারিত্ব চালায় তারা জানে ভাগবাঁটোয়ারা কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। তাই খোদ সরকারের নির্দেশও কার্যকর হয় না।

চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারিভাবে গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি আজও। শুধু তাই নয়, পাহাড় না কাটার কোনো নির্দেশও বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও (সংশোধিত) ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারার ৬-খ অনুচ্ছেদে উলেস্নখ করা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না।' শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় আইনে পাহাড় কাটার জন্য দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা বা ধসের কারণে শত শত মানুষের জীবন গেলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো নজির নেই।

লাখ লাখ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই পাহাড়গুলোর বেঁচে থাকটাও সমান জরুরি। কিন্তু মানুষ তার হিংস্র থাবা বসিয়েছে পাহাড়ের ওপর। বাংলাদেশ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। তার ওপর পাহাড় কাটার কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়ছে। দিন দিন আমাদের জলাময়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা দখলের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে। এর পানিও এখন মারাত্মক বিষাক্ত। ঢাকার চারপাশের অপর তিন নদীর অবস্থাও সঙ্গিন। অবস্থা দেখে মনে হয়, চারদিকে যেন দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা চলছে। দখল দূষণের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান এবং সামান্য জেলজরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু। অথচ পরিবেশ সচেতনতার এই যুগে নদী-খালের দখল দূষণ বন্ধ এবং যথাযথভাবে তা রক্ষা করা সময়ের দাবি। এমনকি দেশের নদনদী রক্ষায় উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দখলকারীরা এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের টিকিটি স্পর্শ করা সত্যি দুষ্কর। দখল-দূষণ বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তাতে রোগের সাময়িক উপশম হলে ক্যান্সারের মতন স্থায়ীভাবে চেপে বসা রোগ থেকেই যায়।

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপরই এ দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের দরকার হয় তা আসে কৃষি জমি থেকেই। কিন্তু দিন দিন এই জমি কমে যাচ্ছে। কৃষি জমির পরিমাণ এতটাই দ্রম্নত কমছে যে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় কৃষি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দরকার হলে এ ব্যাপারে আইন করে হলেও কৃষি জমি রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধিই কৃষি জমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরবাড়ি। যার অধিকাংশ তৈরি হচ্ছে কৃষি জমিতে। এছাড়া জনসংখ্যা বাড়ার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য ক্ষেত্রে। নতুন রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ করতে হচ্ছে। বাড়ছে শিল্প-কারখানা। এসবের জন্য কৃষি জমিই ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙনের ফলেও কৃষি জমি কমছে। এসব কারণে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি জমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

প্রতিবছর দেশে কৃষি জমি কমছে ৮২ হাজার হেক্টর- যা মোট জমির ১ শতাংশ। কৃষিশুমারি ১৯৮৪ ও ২০০৮-এর মধ্যে তুলনা থেকে দেখা যায়, চাষকৃত এলাকার পরিমাণ কমেছে সাত লাখ ৩৩ হাজার একর, অর্থাৎ ২৪ বছরে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষি জমি যে হারে কমছে তাকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষজ্ঞের মতে, প্রতিবছর দেশের জনসংখ্যায় যোগ হওয়া নতুন মুখের জন্য সাড়ে তিন লাখ টন বাড়তি চালের দরকার হয়। একদিকে খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং অন্যদিকে কৃষি জমি কমে যাওয়া রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার। এ অবস্থায় জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

সীমিত আয়তনের বাংলাদেশে জমি খুবই মূল্যবান; এখানে ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতি ইঞ্চি জমি হিসাব করে ব্যবহার করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়নের কারণে দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে বছরে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হচ্ছে। আবাদি জমি যেভাবে কমছে, তাতে দেশে আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা হমকির সম্মুখীন হবে। তাই সারাদেশে জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা দরকার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে দেশে সংরক্ষিত কৃষি জমি ও বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নগরায়ণ ও উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ এক সময় স্বপ্ন থাকলেও এখন তা বাস্তবতা। শুধুই তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে হাইটেক পার্ক। এতে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে দেশ যেমন আরও এগিয়ে যাবে তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থানও। তবে এই পার্ক নিয়ে পরিবেশবিদরা চিন্তিত। তারা বলছেন, যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয় পার্ক নির্মাণের সময় সেটি দেখতে হবে। নানা কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এর মধ্যে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোও যুক্ত হয়েছে। আইটি বর্জ্য সারা পৃথিবীর পরিবেশের জন্যই এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশকেও এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। কারণ যে হারে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে সে হারে বাড়বে প্রযুক্তি বর্জ্যও। এ বিষয়ে এখনই সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে।

পরিবেশ সচেতনতার এ যুগে পরিবেশ দূষণবন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে। সেটা পাহাড় কাটা, কৃষি জমি রক্ষা, হাইটেক পার্ক, নদীদখল, সুন্দরবনরক্ষাসহ যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট

যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ধুযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108579 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1