শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও সাধারণ মানুষ

করোনা টিকার সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা ঘোষণাও করেছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকর নয় বলে মানুষ টিকা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেনি। অক্সফোর্ডের টিকা ও সরকারের দ্রম্নত প্রতিকার এ দেশের মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে যে মনোবল সৃষ্টি করেছে তা প্রশংসারই। ভবিষ্যতে করোনাকে সম্পূর্ণ নির্মূল কীভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন মানবকল্যাণের জন্য।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

করোনা যে ঘাতক রূপ নিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে সর্বশ্রেণির মানুষ প্রথমে ভীত ও চুপসে গিয়েছিল। এমন একটা নতুন ব্যাধি যার প্রতিরোধে কোনো ওষুধ নেই, প্রতিকার সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ ও ভীত। মানুষের মধ্যে করোনা এমনভাবে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল- যা উন্নত দেশও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মানুষ প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তার কারণ, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বিপুল এবং মৃতু্যও হারও বেশি। প্রতিটি দেশে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতাযাত বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ এক অর্থে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সবাই হাত-পা গুটিয়ে স্তব্ধ। উৎপাদন বন্ধ, বিক্রি বন্ধ, বেকার মানুষের চোখে অশ্রম্ন।

করোনা প্রসারের পর দেশীয় সরকার প্রতিরোধের প্রথম স্তরে লকডাউন ও মাস্ক পরার যে বিধি চালু করেছিলেন তা মানুষের অনেক উপকার করে বিস্তৃতির বিপর্যয় রোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণভাবে জনসাধারণ দুটো দিক পালন করলেও স্বল্পসংখ্যক মানুষ মাস্ক পরার ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়নি।

করোনা যেভাবে সারা পৃথিবীতে দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করত। করোনা প্রতিরোধে সারা বিশ্বে প্রায় সমশ্রেণির পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়। বিমান চলাচল বন্ধ, রেস্তোরাঁয় প্রকাশ্যে খাওয়া বন্ধ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ব্যবসায়ীরা কাজ চালানো এবং স্বল্পসংখ্যক কর্মচারীকে অফিসে ব্যবহার, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, পরবর্তী পর্যায়ে ক্রিকেট ও ফুটবল টুর্নামেন্ট খালি মাঠে দর্শকশূন্য অবস্থায় খেলা; বিপণিবিতান বন্ধ। সারাধণভাবে বলা যায়, অর্থকারী সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যায়- একমাত্র ব্যাংক, বিদু্যৎ, গ্যাসের মতো প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া।

করোনা প্রতিরোধে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয় তার বিপরীত প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষ ও চাকরিজীবীদের ওপর। অনেক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হওয়ায় কিছুসংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়। তার ফলে একশ্রেণির মানুষ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ছোট ছোট স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে স্কুলের ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হয় স্কুল কমিটি। রেস্তোরাঁ ও হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তারা খাবার সরবরাহের দিকে অগ্রসর হলে কিছুটা আয়ের পথ দেখতে পায়। প্রথম দিকে খাবারের দোকানে সবশ্রেণির মিষ্টান্নের চাহিদা না থাকায় সেখানেও উৎপাদন কমিয়ে আনতে হয়। অনেক বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে কিছু বাড়িতে ডেলিভারি দেওয়ায় আর্থিক অবস্থা খানিকটা ভালো হতে শুরু করে।

করোনা বিস্তৃতির কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রীরা অলস হয়ে বইপত্র দূরে সরিয়ে রাখে। এদেরই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করায় তারা শিক্ষা সঙ্গে আগের মতোই সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। ঢাকার স্কুলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে ক্লাস শুরু করে। অনলাইনে ক্লাস চালু করলেও সব শিক্ষার্থী উপস্থিত না থাকায় শিক্ষাদানের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে সব শিক্ষার্থীর পক্ষে ল্যাপটপ কেনা সম্ভব হয়নি বলে। ঠিক একই কারণে অন্যান্য স্কুলে অনলাইনে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

করোনা বিস্তারের প্রথম দিকে ঢাকার রাস্তার চিত্র খানিকটা বদলে গিয়েছিল। রাস্তা ভিক্ষুক শূন্য, হিজরাদেরও অনেক দিন দেখা যায়নি। হকাররা বই হাতে বা তোয়ালে নিয়ে রাস্তায় বিক্রি করতে আসেনি। প্রেক্ষাগৃহ শূন্য দর্শকের অভাবে, বাইরে থেকে রেস্তোরাঁর দিকে তাকালে কাউকে দেখা যায় কিছু খেতে। শুধু সরকারি নির্দেশনায় বাস চলছে একজন যাত্রীর পাশের আসন খালি রেখে। অনেকেই বাড়ি থেকে বের হন না। টিভি দেখে সময় কাটান। মানুষ খানিকটা যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল কিছু দিনের জন্য। আর করোনার প্রভাবে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল, মানুষের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছিল তার কোনো হিসাব নেই।

করোনা বিস্তৃতির সময় বাংলাদেশের মানুষের ওপর আর একটি সংক্রামক বিস্তার লাভ করেছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির। প্রথম দিকে শাকসবজির মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় সাধারণ মানুষকে অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়, ক্রয় ক্ষমতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। কয়েক মাস পরেই শাকসবজির দাম কমে আসায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু চাল ও তেলের মূল্য আকস্মিক বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। যা এখনো শেষ হয়নি।

পৃথিবীর কয়েকটা দেশে করোনা ছোবল মারতে পারেনি, সৌভাগ্যক্রমে এ দেশের মানুষ বেঁচে গেছেন দুর্ভাগ্যের হাত থেকে। ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়ার মানুষ ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস, আর শ্রীলংকা, নেপাল, মিয়ানমারের মতো দেশকেও দুর্ভাগ্য বহন করতে হয়নি। বাংলাদেশেও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মানুষ বেঁচে গেছে বাইরে যাতায়াত না করার কারণে। আরও আশ্চর্য এ দেশের অনেক খেটে খাওয়া মানুষকে করোনা স্পর্শ করতে পারেনি।

কিন্তু করোনা শেষ পর্যন্ত মানুষকে শুধু অন্ধকারেই ঠেলে দিতে পারেনি। মানুষ নিজের হাতেই আলোকবর্তিতা নিয়ে এসে সর্বত্র তা ছড়িয়ে দিয়েছে। শুধু মুখে মাস্ক পরে নিজেদের সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। প্রথমে ক্রেতার সংখ্যা কম হলেও বর্তমানে সেই খরা নেই। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তা দিয়ে চলার সময় চারদিকে তাকলেই খোলা দোকান চোখে পড়বে- যা খানিকটা স্বস্তির কারণ বলা যায়।

করোনা বাংলাদেশের মানুষের কম ক্ষতি করেনি। করোনা এ দেশে প্রবেশের পরই প্রত্যেক দিন কিছুসংখ্যক আক্রান্ত মানুষ মারা গেছেন এবং তার চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত মানুষের মধ্যেও বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

সারা পৃথিবীতে করোনা প্রভাব বিস্তার করার সময় বিজ্ঞানীরা চুপ করে বসে থাকেননি, তারা প্রথম থেকেই চেষ্টা করতে শুরু করেছেন কীভাবে মানুষকে বাঁচানো যায় প্রতিষেধক আবিষ্কার করে। নিরন্তর চেষ্টার পরই ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় করোনার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দিলে মানুষ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। করোনা উত্তরণে বিজ্ঞানীরা বসে নেই। পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ড ঘোষণা করে যে, দরিদ্র দেশগুলোকে এই টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশও তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের মানুষ এই ঘোষণাকে স্বাগতম জানায় এবং সেই সঙ্গে স্বস্তিবোধও করে।

অক্সফোর্ডের টিকা আবিষ্কারের পর আরও দুটো ঘোষণা আসে- একটা জার্মানির বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ও অন্যটা আমেরিকার মর্ডানা থেকে। মর্ডানা এ দেশে তেমন পরিচিত না হলেও ফাইজার দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত। জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধ ফাইজার এ দেশে উৎপাদন করত। পরে এ দেশ থেকে ফাইজার ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। অক্সফোর্ড, ফাইজার ও মর্ডানার সঙ্গে তাপমাত্রাগত একটা পার্থক্য বিদ্যমান থাকায় এ দেশে অক্সফোর্ডের টিকা ব্যবহারই সহজ ছিল। কারণ, যে শীতল তাপমাত্রা ফাইজার ও মর্ডানার জন্য প্রয়োজন ছিল তা শুধু হিমাগার ছাড়া আর কোথাও নেই। অবশ্য, ফাইজারও বাংলাদেশকে টিকা দিতে আগ্রহী।

বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব এ দেশে দ্রম্নত টিকার ওষুধ এনে জনসাধারণকে দিয়ে করোনা প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন রক্ষা করা। ওষুধ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে পুশ করার ব্যবস্থা করা হয় দক্ষ কর্মীদের সহায়তায়। প্রথম দিকে জনসাধারণ করোনার টিকা নিতে তেমন উৎসাহ দেখায়নি, একটা দোটানা ভাব তাদের মধ্যে কাজ করেছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ক্রমশ উৎসাহের সঞ্চার হয় এবং টিকাকেন্দ্রে ভিড় করতে থাকে। এই মনোভাব এখনো অধিকাংশের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে এবং প্রতিদিনই আগ্রহের সঙ্গে টিকা নিচ্ছে।

করোনা টিকার সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা ঘোষণাও করেছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকর নয় বলে মানুষ টিকা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেনি। অক্সফোর্ডের টিকা ও সরকারের দ্রম্নত প্রতিকার এ দেশের মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে যে মনোবল সৃষ্টি করেছে তা প্রশংসারই। ভবিষ্যতে করোনাকে সম্পূর্ণ নির্মূল কীভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন মানবকল্যাণের জন্য।

বর্তমানে রাশিয়া ও চীন টিকা তৈরি করেছে। অন্যান্য দেশও এদিক থেকে এগিয়ে যাবে- সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। মানুষ বিপদের সময় উন্নত দেশের বিজ্ঞানী মানবসেবার যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তার চেয়ে বড় মানবতার প্রতি ভালোবাসা আর হতে পারে না। আরও একটি অনন্য দৃষ্টান্তের কথা কারও ভোলা উচিত নয়, তা হলো অক্সফোর্ডের টিকা আর্তমানুষের সেবায় বিনামূল্যে দেওয়া আর বাংলাদেশেও সরকারিভাবে এই টিকা দেওয়া হচ্ছে বিনা অর্থে। মানবতার এমন দৃষ্টান্ত সর্বত্র অনুসৃত হলে মানবসভ্যতা নির্ভয়ে অনেক এগিয়ে যেতে সক্ষম হতো। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেই উচ্চস্থানের অধিকারী নয়, সাধারণ আর্তমানুষের অনন্য সেবার জন্যও মানুষ তাদের কাছে ঋণী। অক্সফোর্ডের কাজ তাদের স্থান আরও অনেক ওপরে নিয়ে গেছে। বিদ্যাচর্চা ও মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিয়ে আইফেল টাওয়ারের মতো আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ : কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে