শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধনে সামনের সারিতে ছিলেন পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান। আর ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব বীর শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
আজাদ
  ১২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের বর্ণনা দেওয়া খুবই কঠিন- সেই সময় যারা সবকিছু নিজের চোখে দেখেছেন, শুধু তারাই এর মর্ম বেদনা উপলব্ধি করতে পারবেন। সেই সময়ের একজন কালের সাক্ষী হিসেবে আমার এই ছোট্ট প্রয়াস-

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিটি দিন ছিল নানান উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় ভরা মাস। একদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছেন আর পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাদা পোশাকে ছদ্মবেশে বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তানে) সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছেন আর সামরিক অস্ত্রের জোগান বৃদ্ধি করছিলেন। যা প্রতিটি স্বাধিকার সচেতন বাঙালির বুঝতে বাকি রইল না। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও এর শেষ পরিণতি বুঝতে বাকি রইল না।

১৯৭১-এর মার্চের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে হার্ডলাইনে চলে যান। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে বাংলাদেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকর পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের এই কয়টা দিন শুধু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র কাগজে-কলমে স্বাধীন না হয়েও স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই পরিচালিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরপর সারা বাংলায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই স্বাধীনতাকামী মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তানি জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো, বাঙালিদের নিধন করার সব প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে যতটুকু জানা যায়- বাঙালির ওপর 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামের ওই নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা হয়েছিল একাত্তরের মার্চের শুরুতেই, জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি পাকিস্তানের লারকানায়। তারা মনে করেছিলেন, ২০ হাজার মানুষ হত্যা করলেই ভয় পাবে বাঙালিরা, স্বাধীনতা এবং স্বাধিকারের কথা আর বলবে না।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগের পর পাকিস্তান পৌঁছানোর আগেই ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশিদের স্বাধীকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের আইনসঙ্গত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল সারাদেশে গণহত্যা। সেই রাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পাক-হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত শত লাশ মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারারাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়। পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় নিহতদের লাশ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে একদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলা চালিয়ে গণহত্যা শুরু করেছে। অন্যদিকে ধানমন্ডি ৩২নং বাসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করছিলেন। ১২টা ২০ মিনিটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে'।

বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এই বার্তা প্রেরণের পরে বঙ্গবন্ধু আরেকটি লিখিত বার্তা সর্বত্র প্রেরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্রেরিত দ্বিতীয় বার্তায় বলা হয়, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রম্নদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আলস্নাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রম্নকে বিতাড়িত করুণ। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আলস্নাহ আপনাদের মঙ্গল করুণ। জয় বাংলা'।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান প্রথম শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে সারাদিন আটক রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ৮৭০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার থেকে এই বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা তার বার্তার আদলে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন এমএ হান্নান, সুলতানুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুলস্নাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চ লাইট'-এর নামে একযোগে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ঢাকায় তখনকার পুলিশ (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। তারা গোলা নিক্ষেপ করে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে, হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি এলাকায়। ইতিহাসের এই নির্মম নিধনযজ্ঞ আর তা রাতেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নারা। সেই রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে প্রতিরোধ শুরু হয়। ইপিআর সদস্যরাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে জীবন দেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশিরা এই দিন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করে। ওই রাতেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুরু করে প্রতিরোধ যুদ্ধ, সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ।

ভারতের অবিস্মরণীয় সমর্থনের ফলস্বরূপ দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই জীবনপণ যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধনে সামনের সারিতে ছিলেন পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান। আর ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আর সব বীর শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

আজাদ : ব্যবসায়ী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে