শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও কার্যকর স্থায়ী কমিটি

স্থায়ী কমিটিগুলো সক্রিয় করার ব্যাপারে পরিষদ আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই।
স্বপন দাশ
  ১৯ মে ২০২২, ০০:০০

আধুনিক স্থানীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ মূলত শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক দর্শনের প্রভাবে। প্রশাসনকে স্থানীয় স্তরে পৌঁছাবার জন্যই স্থানীয় সরকারের গঠন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। অতীতে স্থানীয় সরকার কেবল বিচার বা স্থানীয় বিবাদ মীমাংসা করত কিন্তু আধুনিক সময়ে স্থানীয় সরকার বহুবিধ কাজ করে থাকে। একজন নাগরিকের জন্ম থেকে মৃতু্য পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার যুক্ত। ঔপনিবেশিক শাসনকালে আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার বলতে ব্যবহৃত হয়েছিল ্তুখড়পধষ ঝবষভ এড়াবৎহসবহঃ্থ শব্দবন্ধটি। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচালিত শাসনব্যবস্থার পার্থক্য বোঝাবার জন্যই ্তুঝবষভ্থ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। দেশের সুদীর্ঘকালের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ ইউনিয়ন পরিষদ। যা স্থানীয় এলাকায় কাজ করে। স্থানীয় সরকারের কাজের প্রকৃতি আর্থসামাজিক ও উন্নয়নমূলক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার এই স্তরটিতে প্রান্তিক অংশীদারিত্বের সুযোগ থাকায় তা জনগণের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে। ফলে এই সরকারের গঠন এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্ভব হয়। স্থানীয় প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার সব শ্রেণিপেশার জনগণকে তার অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়ে সচেতন করে তোলে। বর্তমান সময়ে স্থানীয় স্তরে উন্নয়নের মাধ্যম হলো স্থানীয় সরকার।

স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন-২০০৯ এর দ্বিতীয় তফসিলে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমগুলো বাধ্যতামূলক বা ঐচ্ছিক- এভাবে পৃথক না রেখে এ আইনে ৩৯টি কাজের উলেস্নখ রয়েছে। এ আইনের ৪৫ ধারা অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্থায়ী কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। টেকসই তথা শক্তিশালী ইউনিয়ন পরিষদের জন্য এই স্থায়ী কমিটি সক্রিয়করণের মাধ্যমে সুশীল সমাজ, নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্য থেকে যোগ্যতা সম্পন্নদের ইউনিয়ন পরিষদের সামগ্রিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিষদের কাজে গতিশীলতা বাড়াতে এবং সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে উন্নয়নে এক বিশেষ মাত্রা যুক্ত করার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্থায়ী কমিটি ভূমিকা রাখতে পারে। কমিটির সদস্যরা তাদের মেধা ও ঐকান্তিকতা দিয়ে সেক্টরভিত্তিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন।

প্রতিটি কমিটিতে ৫-৭ জন সদস্য থাকে। কমিটি প্রয়োজনে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজনকে কমিটির সদস্য হিসেবে কো-অপ্ট করতে পারবে, তবে কো-অপ্ট সদস্যের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না। পরিষদ গঠনের ১ম অথবা ২য় মাসিক সভায় এজেন্ডা দিয়ে কমিটিসমূহের সদস্য মনোনীত করা হয়। প্রতিটি কমিটিকে প্রতি ২ মাস অন্তর একবার সভা করার বাধ্যবাধকতা আছে। স্থায়ী কমিটির সভাপতি হবেন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি চেয়ারম্যান, সদস্য ও সদস্যারা। চেয়ারম্যান একমাত্র আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হবেন; সদস্য-সদস্যারা এক একটি কমিটির সভাপতি হবেন। যদিও আইনে মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ কমিটির সভাপতি করার বিধান আছে, তবুও সেটি সম্ভব হয়নি। স্থায়ী কমিটির সভার কার্যবিবরণী লেখা হবে, কমিটির সভাপতি কার্যবিবরণী বইটি সংরক্ষণ করবেন। স্থায়ী কমিটির সুপারিশ ইউনিয়ন পরিষদের পরবর্তী সভায় বিবেচনার জন্য কমিটির সভাপতি উপস্থাপন করবেন। সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হবে, বিবেচনায় এলে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হবে। যদি সুপারিশ গৃহীত না হয়, তার কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং স্থায়ী কমিটিকে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে।

স্থায়ী কমিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কার্যক্রমে গতির সঞ্চার করা, স্বচ্ছতা আনয়ন ও নানা পরামর্শ দেবেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা দেখভাল করবেন, প্রয়োজনে মনিটরিং টিমও গঠন করতে পারবেন। এভাবে সব কমিটির সদস্যরা পরিষদীয় কাজে নিজেদের শামিল করে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডেও উৎসাহী ও স্বেচ্ছাসেবীরা নানা কমিটিতে যুক্ত হয়ে পরিষদ পরিচালনার মাধ্যমে ইউনিয়নব্যাপী পরিষদীয় কার্যক্রমের প্রচার ও প্রসার দ্বারা ইউনিয়নবাসীকে সচেতন জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর ঘটানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। আর্থিক বিষয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন, স্যানিটেশন, আইন শৃঙ্খলা উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ, মাদকমুক্ত সমাজগঠন, আর্থসামাজিক কার্মকান্ড, আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি ও ইউনিয়নের নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধিসহ সব বিষয়ে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। কমিটির সদস্যরা পরিষদের মাধ্যমে গতানুগতিক কাজের বাইরে উদ্ভাবনী ও নান্দনিক কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে তা সফল করতে পরিষদকে সহযোগিতা করতে পারেন। সৃষ্টিশীল কাজে তারা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেন। এমনকি স্থায়ী কমিটিগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কমিটিগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে সৃজনশীলতা দিয়ে প্রতিটি কমিটিকে এক একটি উদ্ভাবনী ক্লাবে রূপান্তর ঘটাতে পারেন। জন চাহিদা পূরণে কমিটিসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতার বাতাবরণ সৃষ্টি হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ, হাটবাজারের উন্নয়ন, ইউনিয়ন হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপ ও আদায়ে সহযোগিতা দিতে পারেন। জনগণের আগ্রহ ও আস্থা অর্জনে স্থায়ী কমিটিসমূহ ইউনিয়ন পরিষদ আইনের দ্বিতীয় তফসিলে উলিস্নখিত ৩৯টি কাজের সবখানে নাড়া দিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। দারিদ্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগী নির্বাচনেও কমিটিসমূহ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মতো কর্মসূচিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। কার্যকর ওয়ার্ডসভা ও বাজেট প্রণয়নে পরিষদকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে গণমুখী করে তুলতে পারেন। সামগ্রিক বিবেচনায়, তৃণমূলে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গড়তে স্থায়ী কমিটিসমূহকে সক্রিয়করণের কোনো বিকল্প নেই। স্থায়ী কমিটিসমূহের নিয়মিত সভা করার জন্য একটি সূচি বা ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন পরিষদে থাকতে হবে। লক্ষ্য করেছি শুধু ইউনিয়ন পরিষদে নয়, উপজেলা পরিষদেও উপজেলার ১৭টি কমিটি সক্রিয়করণের দ্বারা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানরূপে প্রতিভাত হয়। স্থায়ী কমিটিসমূহের সদস্য নির্বাচনে কোনো পক্ষপাতদূষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন হলে বা সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিভাজন প্রাধান্য পেলে এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজগঠন বাধাগ্রস্ত হবে। আগ্রহী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধদের এ কাজে যুক্ত করাও একটা উদার গণতান্ত্রিক চর্চার দৃষ্টান্ত হতে পারে।

এবার নজর দেওয়া যাক, বাস্তবে কী অবস্থায় আছে আমাদের তৃণমূলের স্থানীয় সরকারের স্থায়ী কমিটি। খুব কমসংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে স্থায়ী কমিটিসমূহ সক্রিয় আছে। বিধি মোতাবেক স্থায়ী কমিটি গঠন হয় না প্রায়শই। অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এককভাবেই নিজের পছন্দমতো লোকদের দিয়ে দায়সারা কমিটি গঠন করেন। কোথাও কোথাও ইউনিয়ন পরিষদ সচিবও একাজ করে থাকেন। নিয়ম মেনে সভা হয় না ৯০ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদে। অডিট বা কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের ২/১ দিন পূর্বে ইউপি সচিব একাই লেখেন কার্যবিবরণী। যার মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা পরামর্শ থাকে না। গ্রাম পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে কমিটিভুক্ত সদস্যদের স্বাক্ষর আনেন। অনেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জানেন না তিনি কোন স্থায়ী কমিটির সভাপতি। অধিকাংশ সদস্য জানেন না তিনি কোন কমিটিতে আছেন। কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা জানেন না স্থায়ী কমিটিতে তাদের কাজ বা ভূমিকা কি? কোন কোন ইউনিয়ন পরিষদে কখনই কোনো কমিটির সভা হয়নি। ২/১টি কমিটি সভা হলেও তার লিখিত কার্যবিবরণী, হাজিরা খাতা ও নোটিশ বইয়ের হদিস থাকে না। সবই ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বা চেয়ারম্যান নিয়ন্ত্রণ করেন। যেখানে কিছুটা সক্রিয় এবং বিধি মোতাবেক কার্যক্রম আছে সেখানে ফলোআপ নেই। অর্থাৎ স্থায়ী কমিটির সুপারিশ সভাপতি পরবর্তী পরিষদ মাসিক সভায় উত্থাপন করেন না। শতকরা ৯৫ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক সভায় কার্যবিবরণীতে স্থায়ী কমিটির প্রস্তাব বা পরামর্শের কোনো উলেস্নখ নেই। কোনো বিশেষ প্রকল্প বা উদ্যোগ স্থায়ী কমিটির পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এমন নজির নেই শতকরা ৯৮ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদে। এতে সহজেই অনুমান করা যায় কি অবস্থায় আছে ইউনিয়নের স্থায়ী কমিটিসমূহ।

স্থায়ী কমিটিগুলো সক্রিয় করার ব্যাপারে পরিষদ আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই।

পরিষদে জনবল কম হওয়ায় চেয়ারম্যানের আগ্রহ না থাকলে একমাত্র পরিষদ সচিব এ বিষয়ে লোকাল গভর্নমেন্ট সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি)-এর জেলা সমন্বয়কারীর নিকট পরিস্থিত ব্যাখ্যা করে থাকেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা উপ-পরিচালক তার ইউনিয়ন পরিষদ পরিদর্শনকালে বিষয়টি নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কথা বললেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। উপেজেলা নির্বাহী অফিসাররা এটি নিশ্চিতে সময় কম পান। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের বাধ্য করার জায়গায় তিনি যেতে পারেন না চেয়ারম্যানরা সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ার কারণে। অনেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের কাছের লোক হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের বিধিমালার ধারে কাছেও যান না। কিছু ইউনিয়ন পরিষদে মাসিক সভাও ঠিকমত হয় না। ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সব সামলান, তিনি চেয়ারম্যান সাহেবের কথা ও মর্জিমতো মাসিক সভার কার্যবিবরণী লেখেন। সদস্যরা পরিষদে এলে হাজিরায় স্বাক্ষর নিয়ে নেন, সব ইউনিয়ন পরিষদে মাসিক সভার তারিখ নির্ধারিত না থাকায়। কোনো প্রকল্প কমিটি বা কোনো তালিকা অনুমোদনের প্রয়োজন অনুযায়ী সভা দেখানো হয় মাত্র। সদস্য-সদস্যারা সভার হাজিরায় স্বাক্ষর করেন, সভার কার্যবিবরণীতে কী আছে সে সম্পর্কে অবহিত না হয়েই। অনেক সময় অবহিত হয়ে স্বাক্ষর করেন। ভিন্নমত থাকলেও কথা বলেন না, প্রকল্প পাওয়ার প্রত্যাশায়। অনেক সদস্য আছেন অনিয়মের প্রতিবাদ করে সবকিছু থেকে বাদ পড়েন। এ বিষয়গুলো জেলা বা উপজেলা থেকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলত, জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অনিয়ম দূরীকরণেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। অর্থ ও সংস্থাপন সংক্রান্ত কমিটিতে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এ বিষয়ে মুখ খোলার সাহস কেউ দেখান না। কারণ চেয়ারম্যানরা সরকারদলীয় হলে এক ধরনের একনায়ক সুলভ মনোভাব দ্বারা তারা চালিত হন। সরকারি দলের বাইরে কেউ চেয়ারম্যান হলে সেখানে তিনি চাপে থাকেন বা উন্নয়নের অনেকে ক্ষেত্রে সেই ইউনিয়ন বঞ্চিত হয়। এটা সাধারণ চিত্র। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় যার কোনো স্থান নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল ও কদর্য বলেই এই পরিস্থিতি। স্থায়ী কমিটিসমূহ সক্রিয় থাকলে অনেক ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ রোধ করা যেত বা রোধ হতো। প্রয়োজনের তাগিতে ইউনিয়ন পরিষদ মনে করলে ইউনিয়ন পরিষদ আইনের ৪৫ (২) উপ-ধারা (১) অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের অনুমোদনক্রমে অতিরিক্ত স্থায়ী কমিটি গঠন করতে পারেন। এমনটি অনেক ইউনিয়ন পরিষদে আছে।

কার্যত তৃণমূলে যে সব ইউনিয়ন পরিষদ বিশেষ ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেছে, জনবান্ধব ও অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার গড়ে তুলেছে সেখানে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে স্থায়ী কমিটিসমূহের ধারাবাহিক কার্যক্রম। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেখানে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গড়ে তুলেছেন নতুন এক স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সব ভালো কাজে অর্থের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় স্বদিচ্ছার সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ, চেতনার উন্মেষ ও সামাজিক পুঁজি সৃষ্টির ঐকান্তিকতা। স্থায়ী কমিটিসমূহের এক দল অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষ তাদের নিষ্ঠা, সামর্থ্য ও সৃজনশীলতা দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদকে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের চাহিদা পূরণে সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে আমরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটিসমূহের কার্যক্রম নিয়ে প্রতি বছরের 'বেতাগা দিবস' উদ্‌যাপনকে মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। যেখানে প্রতি বছর এক বিশেষ দিনে স্থায়ী কমিটিসমূহের বছরব্যাপী কার্যক্রমকে তুলে ধরতে স্টল সাজিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বছরের এই বিশেষ দিনে জনজোয়ারে পস্নাবিত হয় এ অঞ্চলের পথঘাট। এক অভূতপূর্ব উন্মাদনায় মত্ত হয় এ জনপদ। মতপথ, ধর্ম-বর্ণ, নর-নারী কিংবা শিশু-বৃদ্ধ সব ভেদাভেদ মুছে গিয়ে মিলনের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৃঙ্খলার মিশেল আঞ্চলিক বৈশিষ্টের মৌলিকত্ব তুলে ধরে। আত্মনির্ভর সমাজের কল্পনা নির্মাণ করে চলে আপন মনে। বারে বারে ফিরে দেখে নিজেদেরই গড়া কৃতিত্বের মাইলফলক। বুক বাঁধে নুতন সাফল্য, নতুন অর্জনের নিশান ওড়ানোর শপথে। বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদে ১৪টি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তারা প্রতিবন্ধিতা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি নামে জেলা প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে এই কমিটি গড়েছেন। এই ইউনিয়নের প্রতিটি স্থায়ী কমিটির টিম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য-সদস্যার নেতৃত্বে তাদের মেধা, সৃজনশীলতা ও নানা উদ্ভাবনী কর্মকান্ড দ্বারা কমিটিগুলোকে সমৃদ্ধ করেছেন। যেমন কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক স্থায়ী কমিটির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত অর্গানিক বেতাগা, পোল্টি ফার্মিং ও গাভী পালনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও মৎস্য চাষে নতুন উদ্যোগ ইত্যাদি। এর দরুন নিরাপদ খাদ্য ও সবজি উৎপাদন, ডিমও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মৎস্য চাষ ও উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে এই সেক্টরের খামারিদেরও সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। উদ্ভাবনী চর্চায় অর্গানিক বেতাগা আজ এই জনপদে ব্যাপক প্রশংসিত উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি তাদের একাধিক উদ্যোগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন- যা শুধু বেতাগাকে নয়, সব ইউনিয়ন পরিষদের কাজে নতুনত্ব এনেছে। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষা সহায়তা ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে বৃত্তি প্রদান, জন উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা ছাড়া তহবিল গঠন, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সমন্বয় সভা, অভিভাবক সভা ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে ভবন নির্মাণে পরিষদকে সম্পৃক্ত করা, কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় পরিষদকে কার্যকর ও দক্ষ করে তোলা, গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাপক মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা, প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারিতে ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা বা চিকিৎসার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক কেন্দ্রিক তহবিল গড়ায় উদ্যোগ উৎকৃষ্ট নজির হতে পারে। আর এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। পুরো ব্যবস্থাটি একটি টেকসই ব্যবস্থায় উন্নীত হতে পারে বলে বিশ্বাস করি।

পারিবারিক বিরোধ নিরসন, নারী ও শিশু কল্যাণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি নারীদের সমঅধিকার এবং তাদের ও কন্যা শিশুদের ক্ষমতায়ন, বিকাশ ও উন্নয়নে 'কন্যা বর্তিকা কর্মসূচি' চালু উদ্ভাবনী চর্চা এবং টেকসই অভীষ্ট অর্জনে দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বাল্যবিয়ে রোধে যা ইউনিয়িনবাসীকে নাড়া দিচ্ছে।

স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির উদ্ভাবনী সিদ্ধান্তে পরিষদ থেকে সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে মার্কেটিং ল্যাট্রিন নির্মাণ, ১১ লাখ টাকার ঘূর্ণায়মান তহবিল গঠন, পাইপলাইন ওয়াটার সাপস্নাই ব্যবস্থাকে লাভজনক করে বাৎসরিক প্রায় ৪ (চার) লাখ টাকা রাজস্ব মুনাফা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।

এছাড়া শতভাগ ট্যাক্স আদায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগী নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়ন গড়ে তোলাসহ স্থায়ী কমিটির অনেক কাজ উদ্ভাবনী চর্চার নিদর্শন বহন করে। সুতরাং নির্দ্বিধায় সব স্ট্যান্ডিং কমিটিকে থিংক ট্যাংকের ভূমিকায় রেখে যেমন টেকসই সেবা প্রদান করা সম্ভব; পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারীদেরও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সহজতর এবং বেতাগার আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হয়েছে।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নাগরিকের অধিকার, কর্তব্য, অংশগ্রহণ, মালিকানার ধারণা আজ এলাকার মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও আস্থা কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, ধর্ম, রাজনীতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের অটুট বন্ধন কীভাবে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে বেতাগার মানুষ আজ তার দিশা দেখাচ্ছে। আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি কীভাবে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ইতিবাচকতার ধারায় বদলে দিতে পারে তার সাক্ষী বেতাগা ইউনিয়নের স্থায়ী কমিটিসমূহ।

স্বপন দাশ : উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ফকিরহাট, বাগেরহাট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে