শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব'তে বুলিং, ব'তে বর্ণবাদ

আলী তানবীর
  ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

আমাদের দেশে বর্ণবাদকে বুলিং বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৫ মে তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামের ৪৬ বছর বয়সি একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানকে অবৈধ মুদ্রা রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু চেপে ধরায় শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে মৃতু্য হয়। ওই মৃতু্যকে কেন্দ্র করে বর্ণবাদের বীভৎস রূপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমেরিকা, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে বিক্ষোভ হয়; কিন্তু বাংলাদেশে কি বর্ণবাদ নেই? বাস্তব প্রেক্ষাপট কি বলে? সেদিন ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের মেধাবী ছাত্র তরুণ তার পারিপার্শ্বিক সমাজের বৈষম্যের গস্নানি সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই পরোক্ষ হত্যার পেছনে আসলে কে বা কারা দায়ী? নিশ্চয় দূরের কেউ না। তরুণের বর্ণ কালো এবং সে দরিদ্র পরিবার থেকে আসায় তার সহপাঠী, শিক্ষক ও আশপাশের মানুষের বুলিং, অবজ্ঞা ও অপমানের যন্ত্রণা তাকে পরোক্ষ মৃতু্যর দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের দেশে এভাবে প্রতিনিয়ত উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি কত মানবসত্তাকে খুন করে যাচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তরুণের মৃতু্যর পর তার সহপাঠী বন্ধুরা ১৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল। সেই বিক্ষোভকারী সহপাঠী ও তাদের দাবিগুলো যদি তরুণ দেখার সুযোগ পেত তাহলে হয়তো তরুণ মনে মনে হেসে আঙুলের ইশারায় বলে দিত যাদের ঘৃণ্য আচরণে আমি মৃতু্যকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি তাদের কয়েকজনকেও প্রতিবাদ মিছিলে দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে দাবিগুলোও বেশির ভাগ আত্মকেন্দ্রিক এবং খুব সূক্ষ্ণভাবে মূল বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যা দেখে তরুণের আত্মা মরেও শান্তি পাচ্ছে না। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের দিনে মানুষের ঘৃণ্য আচরণ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়া হত্যার চেয়েও মারাত্মক নয় কী? তরুণ নামের ছেলেটিকে মরার আগে কতবার যে মরতে হয়েছে সেটা একমাত্র বর্ণবাদ বা বুলিংয়ের শিকার ভিক্টিমরা ভালো উপলব্ধি করতে পারবে।

বর্ণবাদের নির্দিষ্ট কোনো বর্ণ নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা। চামড়ার বর্ণবৈচিত্র্য থেকে বর্ণবাদ সবার অস্থিমজ্জায় গেঁথে গেছে। কখনো বর্ণ, কখনো ভাষা, কখনো ধর্ম, কখনো জাতপাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে মানুষের মধ্যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমাদের দেশেও বর্ণের ভেদাভেদ দেখতে বেশিদূর যেতে হবে না। বর্ণবাদ দেখতে আমেরিকা বা আফ্রিকার দিকে তাকাতে হবে কেন? হাতের কাছেই থাকা খবরের কাগজে পাত্রপাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেখলেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। বিজ্ঞাপনের ওপর একটু চোখ বুলালে দেখা যায় প্রায় সবার চাহিদা ফর্সা ও সুন্দরী পাত্রী। তার মানে কালো মেয়েরা বিয়ের অযোগ্য, রবিঠাকুর যতই কৃষ্ণকলির 'কালো হরিণ চোখের' জয়গান করুন অথবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যতই লিখুক 'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতের সবারই সমান রাঙা'। এসব শুধু সাহিত্যে ঠিক আছে? লেকচার দেওয়ার সময়ও চমৎকার; কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিদের মননে মানসে লালিত হয় সাদা চামড়ার প্রতি অকৃত্রিম টান ও ভালোবাসা। আমাদের দেশে এখন মেয়ে হয়ে জন্মানোকে তেমন অপরাধ মনে করা না হলেও কালো হয়ে জন্মানো যেন চরম অপরাধ। তার প্রতি অনাদর ও বৈষম্য শুরু হয়ে যায় গোড়া থেকেই। কিছুদিন আগে আমার এলাকার এক মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই বিয়ে ভেঙে যায়। অভিযোগ মেয়ে নাকি বিয়ের আগে সাক্ষাতের সময় ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহার করেছে। স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যে দেশে কালো মেয়েদের বিয়ে হওয়ার জন্য ফর্সা হওয়ার ম্যাজিক ক্রিম ব্যবহার করতে হয়, আবার সেই সব ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলো পত্রপত্রিকায় ঢালাওভাবে প্রচার করে মেয়েদের ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে সে দেশ কি

আসলেই বর্ণবাদমুক্ত!

বুলিং বা বর্ণবাদ যেটাই বলি না কেন আমাদের দেশে মূলত তার সূচনা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের মধ্যে কারও চোখ খয়েরি অথবা কেউ দেখতে একটু কালো বর্ণের, কারও শরীরের গঠন একটু মোটা বা চিকন অথবা কেউ দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। এই সব ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা বিশেষগুণগুলোকে অপমানজনক শব্দে ব্যবহার করে ভিকটিমকে মানসিক নির্যাতন, জনসমক্ষে হেয়প্রতিপন্ন ও তিরস্কার করা হয়। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা একজোট হয়ে এমনভাবে কটাক্ষ করে যেন একঝাঁক বুনো কুকুরের দল একটি বাঘকে শিকার করছে। সেখানে ভিকটিম যতই শক্তিশালী হউক না কেন হিংস্র কুকুরের পালের সঙ্গে পেরে ওঠে না। অপদস্ত হতে হয় অবিরাম। কখনো সহপাঠী বা শিক্ষক আবার কখনো প্রতিবেশী বা আশপাশের মানুষে দ্বারা বিভিন্নভাবে শারীরিক, মৌখিক, সম্বন্ধযুক্ত, সমষ্টিগত, প্রতিবন্ধকতা ও অ্যাডাম টিজিংয়ে শিকার হতে হয়। এমনকি মাঝেমধ্যে ভিকটিমের সঙ্গে যারা মিশে বা ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদেরও বুলিংয়ে শিকার হতে হয়। এই সমস্ত কারণে ওই শিশুদের বন্ধুরা এড়িয়ে যেতে চায়। ধীরে ধীরে সে নিঃসঙ্গ হতে শুরু করে এবং কারও সঙ্গে মিশতে ভয় পায়। বুলিংয়ের শিকার হতে হতে একসময় এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়ে যে ক্লাসে অমনোযোগী হয় এবং স্কুলে যেতেও ভয় পায়। এতে ওই শিক্ষার্থীগুলোর গ্রেড নিচে নেমে যেতে থাকে। একসময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কেউ কেউ এ কারণে স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে। অনেকে এসব সহ্য করেও চড়াই-উতরাই পার হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। অনেক সময় দেখা যায় মাত্রাতিরিক্ত বুলিংয়ের প্রভাবে ভিকটিম আগ্রাসী হয়ে ওঠে অথবা আত্মহত্যা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তরুণকে একদিনে হত্যা করা হয়নি। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি চাকরি জীবনেও আমরা বুলিং বা বর্ণবাদ নামক এই ঘৃণ্য মনমানসিকতার কারণে কত তরুণকে হারাচ্ছি। কত লাখ লাখ তরুণ সারা দেশে এমন সব গস্নানি সহ্য করে জীবন মৃত অবস্থায় বেঁচে আছে। এখনই সময় বর্ণবাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলার। না হয় এমন এক সময় আসবে আমাদের দেশেও বর্ণবাদ মহামারি আকার ধারণ করবে। আজ তরুণ বলি হলো। কাল আমি, আপনি, অথবা আমাদের পরিবারের কাউকে হারাব না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তাই আমাদের সবার প্রবাদটি উপলব্ধি করা উচিত, 'কারও জন্য খেলা, কারও জন্য মৃতু্য'। সচেতন বা অবচেতনভাবে আমরা কারও সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অপমান, অপদস্ত বা হেয় করা থেকে দূরে থাকি। আসুন আমরা সবাই আমাদের মস্তিষ্কে বৈষম্যের গজানো শিকড় উপড়ে ফেলে আগামী প্রজন্মকে ঘৃণাহীন, সহিংসবিহীন ভবিষ্যৎ উপহার দিই।

আলী তানবীর

শিক্ষার্থী

ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে