সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

নতুন শিক্ষাক্রম বনাম জাতীয়করণের আন্দোলন

মাজহার মান্নান
  ৩০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কিছুদিন আগে সরকার নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে। একেবারেই নতুন ধাঁচের এই শিক্ষাপদ্ধতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবার আগে দরকার শিক্ষকের অংশগ্রহণ। শিক্ষকদের কিছু প্রশিক্ষণও ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি তো লেজেগবরে অবস্থা। যারা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করবেন তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে বসে শিক্ষা জাতীয়করণের আন্দোলন করে যাচ্ছেন। খেয়ে না খেয়ে, নির্মম যন্ত্রণা সহ্য করে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা তাদের দাবি পেশ করে চলেছেন। যাদের ক্লাসে থাকার কথা তারা রাস্তায় সংগ্রামে ব্যস্ত। ক্ষতি তবে কার হচ্ছে? শিক্ষক? শিক্ষার্থী? রাষ্ট্রের? সহজভাবে ভাবলেই বোঝা যায় একটি সার্বিক ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হচ্ছি। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এ মুহূর্তে তাদের দরকার শিক্ষকদের সরাসরি তত্ত্বাবধান। কিন্তু কোথায় আজ শিক্ষক? কেন শিক্ষকদের বারবার রাস্তায় নামতে হচ্ছে। জাতীয়করণের দাবি তো নতুন কোনো দাবি নয়। দীর্ঘ দিনের এই দাবিটিকে সরকারের উচ্চমহলও যৌক্তিক মনে করে। তাহলে বাধা কোথায়? কেন জাতীয়করণ হয় না? শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা কেমন তা নতুন করে লিখে কলেবর বাড়াতে চাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দেখলে সহজে অনুমান করা যায় কি দৈন্য অবস্থা আমাদের শিক্ষকদের। প্রায়ই শোনা যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলার ফাঁদে আটকা পড়েছে জাতীয়করণসহ নানা সুবিধা। কিন্তু কেন? শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করার প্রতিশ্রম্নতি তো বড় রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে ছিল। কোথায় গেল সেই আশ্বাস? সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এবং অন্যান্য কি কি চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার একটি গবেষণাভিত্তিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। বেসরকারি পর্যায়ে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জরিপ করা হলেও পূর্ণাঙ্গ জরিপ এখনো হয়নি। তবে খন্ডিত জরিপ এবং বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে যেটা অনুমান করা যায় সেটা হলো জাতীয়করণের জন্য অর্থের চেয়ে সদিচ্ছাটি বেশি প্রয়োজন। বেশির ভাগ শিক্ষক মনে করেন যে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবি যখনই জরালো হয় তখন তা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জালে আটকা পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের এ ধারণা কতটুকু সঠিক তা যাচাই করার সুযোগ নেই। তবে এতটুকু আন্দাজ করা যায় যে শিক্ষকরা কোনোকিছুই সহজভাবে পায়নি। কঠোর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়েই তাদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের যেমন ক্ষতি হয়েছে তেমনি ক্ষতির শিকার হয়েছেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন খুললো তখন শিক্ষকদের আসতে হলো প্রেস ক্লাবে আন্দোলন করার জন্য। প্রতিকূল পরিবেশে জাতীয়করণের দাবি নিয়ে শিক্ষকরা প্রেস ক্লাবে অবস্থান নিয়েছেন। সারা বছরই শিক্ষকদের কোনো না কোনো অংশ তাদের দাবি আদায়ে প্রেস ক্লাবে অবস্থান করেন। কিন্তু কেন? শিক্ষকদের কেন বারবার তাদের দাবি আদায়ে প্রেস ক্লাবে অবস্থান করতে হবে? আরও তো বহু চাকরিজীবী আছেন, তারা কয়দিন প্রেস ক্লাবে তাদের দাবির পক্ষে অবস্থান করেন? এর থেকেই বোঝা যায় যে শিক্ষকরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা প্রয়োজন নিম্নোক্ত কারণেই। ১. শিক্ষায় বৈষম্য দূর করে সমতা আনার জন্য ২. শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য ৩. শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর করার জন্য ৪. শিক্ষা খাতের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য ৫. শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়ম দূর করার জন্য ৬. শিক্ষকদের মর্যাদা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য ৭. গ্রামীণ শিক্ষাকে বেগবান করার জন্য ৮. বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান নানা জটিলতা দূর করার জন্য ৯. অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ১০. শিক্ষা খাতে বর্তমানে সারা দেশে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। শিক্ষা গবেষক ও বিশ্লেষকদের মতে এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে বেতন, সেশন ফি ও অন্যান্য টাকা আদায় হয় সেটার সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু অর্থ বরাদ্দ দিলে অনায়াসে একযোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা সম্ভব। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও উৎসব ভাতা বাবদ প্রায় ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এটাকে ১৫ হাজার কোটি টাকায় নিতে পারলে জাতীয়করণ অনায়াসে সম্ভব। সারা দেশে ৩৯ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শিক্ষক রয়েছেন যারা এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশের শিক্ষা খাতের চাকাকে চলমান রাখতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশি, অথচ তারাই আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সরকার ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু তাতে প্রকৃত সমস্যার কোনো সুরাহা হবে না বরঞ্চ সমস্যা আরও প্রকট হবে। জাতীয়করণের তালিকা থেকে যারা বাদ পড়বে তাদের হতাশা ও বৈষম্য বহুগুণে বেড়ে যাবে। একযোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে যে খরচ হবে সেটা পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচের তুলনায় কিছুই না। এখানে সদিচ্ছাটাই বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্রপ্রধানকে সঠিক তথ্য, উপাত্ত ও জরিপ দিয়ে বোঝানো গেলে জাতীয়করণের পথ সুগম হবে। কিন্তু কে বোঝাবে? সরিষার ভিতরে ভূত কে তাড়াবে? তাই রাষ্ট্রপ্রধানকেই মূল উদ্যোগটি নিতে হবে। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তার। ২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর প্রচুর আয় রয়েছে। জাতীয়করণ করা হলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার বিপুল অর্থ জমা পড়বে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বেতন সমন্বয়ের মাধ্যমে আয় বুদ্ধির সুযোগ রয়েছে। প্রেস ক্লাবে শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান নিয়েছে। তাদের দাবি অবশ্যই যৌক্তিক। আর তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সরকার সদাশয় হবেন এটাই প্রত্যাশা। রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা না নেয় তবে সে দেশ কখনোই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে আর এর পিছনের কারিগর হলেন শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকের পেটে ক্ষুধা রেখে তাদের কাছে বিদ্যার প্রত্যাশা করা আসলেই কি যৌক্তিক?

মাজহার মান্নান

কবি ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে