সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিন্তাশক্তিই নতুনত্বের পথপ্রদর্শক

চিন্তাশক্তির প্রসারের জন্য প্রয়োজন চিন্তকদের জায়গা সৃষ্টি করা, নতুন কাঠামো প্রণয়ন করা। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি হয়ে উঠবে একেকজন চিন্তক।
রুদ্র ইকবাল
  ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

চিন্তাশক্তির উৎকর্ষতা জীবনের প্রত্যেক স্তরে নতুনত্ব সৃষ্টি করে, প্রয়োজনের আলোকে নতুন পাথেয় আবিষ্কার করে। সৃজনশীলতা কিংবা চিন্তার সাহায্যে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান যেভাবই শুরু করি জ্ঞানের এই প্রক্রিয়া সভ্যতার গোড়াপত্তন থেকে আমাদের পথ দেখিয়েছে। অনুসন্ধান এবং নতুন জ্ঞান সংযোজনের দ্বারা নতুন নতুন আবিষ্কারই মানুষকে আদিমযুগ থেকে এই আধুনিক যুগে নিয়ে এসেছে। নতুনত্বের এমন সংযোগ আমাদের ব্যবহারিক জীবনকে আরও সহজতর করেছে। চিন্তার উৎকর্ষতার দ্বারা নতুনত্বের আবিষ্কার মানুষের জীবনকে করেছে সহজ থেকে সহজতর। সৃজনশীলতা কিংবা নতুনত্ব যা-ই বলি না কেন এই দুই স্তর মানুষের চিন্তাশক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।

মানুষ আদিমযুগে গুহায় বসবাস করত, কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত, পাথর দিয়ে শিকার করত। কিন্তু প্রয়োজনের নিরিখে মানুষ তার চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছে নতুন সব আবিষ্কার। সভ্যতার প্রাথমিক দিকে তারা আবিষ্কার করেছিল চাকা, শিকারের জন্য বলস্নম, তীর ইত্যাদি। ক্রমান্বয়ে এই চাকা থেকেই বর্তমানের দ্রম্নতগতিসম্পন্ন গাড়ি ও নানা প্রযুক্তির সৃষ্টি। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো- অন্যান্য প্রাণী সৃজনশীলতার অভাবে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে ব্যর্থ বিধায় তাদের আদিমকাল থেকে জীবনপ্রণালি একরকম কিন্তু মানুষ বিভিন্ন স্তর পার করে চিন্তাশক্তির দ্বারা নানা আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে আজকের এই প্রযুক্তির বিশ্বে।

সৃজনশীল জ্ঞান সৃষ্টির নিরিখে স্থাপিত হয়েছে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টি'ই বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে, শেখাতে সৃষ্টি হয়েছে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা মূলত শিক্ষার্থীদের নিজস্বভাবে চিন্তা করতে শেখায়। একচেটিয়া মুখস্থ বিদ্যা যখন শিক্ষার্থীদের একমুখী ও উপলব্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের উপলব্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে শেখায় এবং সৃষ্টি করে নতুনত্ব। সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম একটি দিক হলো- এই পদ্ধতি শুধু জ্ঞানার্জনে নয়, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

তবে সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হলো- সৃজনশীল পদ্ধতি সব জায়গায় চালু হলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ সব জায়গায় বাজারের নোটপদ্ধতির অনুসরণ সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নোটের হুবহু উদ্দীপক ও প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্নে হুবহু তুলে দেওয়ার দরুণ শিক্ষার্থীরা সেই প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে নিজস্ব চিন্তাকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আহমদ ছফা তার 'যদ্যপি গুরু' বইয়ে রাজ্জাক স্যারের বয়ানে লেখেন, 'একটি বই পড়া তখনই সার্থক হয়, যখন একজন পাঠক সে বই পড়ে নিজের মতো করে বলতে পারে।' রাজ্জাক স্যার এই কথার মধ্যদিয়ে সুন্দর একটা বিষয় তুলে ধরেছেন। বই পাঠের মধ্যদিয়ে শুধু গাদা গাদা তথ্য মুখস্থ না করে বরং বইয়ে উলিস্নখিত তথ্য ও তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যক্তি যখন নিজের চিন্তা, মত উপস্থাপন করে তখন-ই তা হয়ে ওঠে প্রকৃত পাঠ এবং এই পদ্ধতি থেকেই শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হয়ে ওঠে সবচেয়ে বেশি।

একটি সুন্দর গোছানো চিন্তাশক্তির সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা সাহিত্যচর্চার পরিবর্তে সাহিত্যের কতগুলো তথ্য মুখস্থ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে বিজ্ঞানচর্চা ও নতুন আবিষ্কারের পরিবর্তে বিজ্ঞানের কতকগুলো থিওরি, সূত্র মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে গিয়ে লিখে দিয়ে আসতেছে। ব্যবসা শিক্ষার শিক্ষার্থীরা দেশের আর্থিক সংকট নিরসনের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার ও সমাধানের পরিবর্তে গাদা গাদা নোট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখতেছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় জায়গাটাই জ্ঞানচর্চার ও জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা কিন্তু জ্ঞান সৃষ্টির পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার দ্বারা তথ্য আত্মস্থ করে যাচ্ছে। সৃষ্টিশীল হওয়ার পরিবর্তে রোবটিক হয়ে উঠতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আরও একটি আক্ষেপের বিষয় হলো- স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর দীর্ঘদিন পড়ে আসা বিষয়গুলো বাদ দিয়ে চাকরি পাওয়ার নিমিত্তে শুরু করতে হয় নতুন সাধারণ জ্ঞানের বই, নবম-দশম শ্রেণির বিভিন্ন পাঠ। দীর্ঘসময় তত্ত্বীয় পড়াশোনার পর নতুনভাবে সাধারণ জ্ঞান, নবম-দশম শ্রেণির পাঠ মুখস্থ করা শিক্ষার্থীদের মনে এক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। স্নাতক জীবনের পড়াশোনার চাকরি পাওয়ার পেছনে তেমন গুরুত্ব না থাকায় এই তত্ত্ব তারা যতটা না রপ্ত করে তার চেয়ে বেশি রপ্ত করে। কথা হলো- কোন তত্ত্ব সম্পর্কে জানা (সেটা বিষয়েরই হোক) আর সেই তত্ত্ব আত্মস্থ/রপ্ত করা দুইটা এক বিষয় না।

চিন্তাশক্তির প্রসারের জন্য প্রয়োজন চিন্তকদের জায়গা সৃষ্টি করা, নতুন কাঠামো প্রণয়ন করা। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি হয়ে উঠবে একেকজন চিন্তক।

রুদ্র ইকবাল : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে