বর্ষা মৌসুম আসার আগেই পদ্মার ভাঙনে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বিভিন্ন জনপদের মানুষ। নদীভাঙনে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে উপজেলার বড় নওপাড়া, সুন্দিসার, বেজগাঁও ও গাঁওদিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব এলাকায় পদ্মার তীরে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। বুধবার রাতে উপজেলার বেজগাঁও গ্রামের বেশ কিছু বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। পদ্মায় তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে মাটি সরে গেছে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চবিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায়। এতে বিপুলসংখ্যক বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হাজার হাজার বাল্কহেড দিয়ে নদী থেকে বালু লুট করে নেওয়ায় নদীভাঙন বাড়ছে। তীব্র ভাঙনে পদ্মা তীরের হাজারো পরিবারের সাজানো-গোছানো ঠিকানা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আতঙ্কে এলাকাবাসীর চোখে ঘুম নেই। ভাঙনের আশঙ্কায় বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অনেকে গাছপালা কেটে নিচ্ছেন। কেউ কেউ রশি-বাঁশ দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯২ সাল থেকে পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে লৌহজং উপজেলা সদরসহ ৪০ গ্রাম ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার ১০ গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। গত বছর জেলার লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় পর্যন্ত ৯.১ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মার তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ভাঙন এলাকার মধ্যে গাঁওদিয়া, বড় নওপাড়া, সুন্দিসার, বাঘেরবাড়ী প্রকল্পের আওতায় থাকলেও রাউৎগাঁও প্রকল্পের বাইরে রয়েছে। নদীভাঙন পদ্মা তীরের অধিবাসীদের জন্য এক অভিশাপের নাম। এ ভাঙন রোধে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নদীতীরবর্তী এক এলাকা রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করলে অন্য এলাকায় দেখা দেয় ভাঙন। পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে মুন্সীগঞ্জে ৪৪৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকলেও অন্য এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় নতুন করে ৪ কিলোমিটার এলাকার ভাঙন রোধের উদ্যোগ চলছে। আমরা আশা করব, এ ব্যাপারে দ্রম্নত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে, প্রতিনিয়ত পলি জমে জমে নদী ভরাট হচ্ছে। ফলে বর্ষায় বৃষ্টির পানি ও উজান থেকে আসা ঢলের পানি নদী ধারণ করতে পারে না। তখন দুকূল ভাসিয়ে যায়। নদীভাঙনে প্রতি বছর শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়। হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের বিভিন্ন পয়েন্টে পদ্মা নদীর তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ভাঙন শুরু হয়েছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের ২০০ মিটার উজানে অবস্থিত নতুনপাড়া গ্রামে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের চর ঘাগুয়া গ্রামের বাসিন্দারা যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানোর আতঙ্কে রয়েছে। গত এক সপ্তাহে এই গ্রামের ১২টি পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। কাজলা ইউনিয়নের চর ঘাগুয়া ঘাটের উত্তর পাশ থেকে চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের মানিকদাইড় পর্যন্ত সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে এই ভাঙন।
কয়েক দশকের অবহেলায় নদীগুলোর আজ এমন শোচনীয় অবস্থা। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নদী খননের জন্য কোনো ড্রেজারই ছিল না। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার চারটি ড্রেজার কিনেছিল। সেগুলো দিয়ে মূলত ফেরিঘাটগুলো সচল রাখা হতো। এরপর কোনো সরকার আর কোনো ড্রেজার কেনেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পরই আবার ড্রেজার সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। এ পর্যন্ত তিন ডজনের বেশি ড্রেজার সংগৃহীত হয়েছে এবং তা দিয়ে নদী খননের কাজ চলছে।
\হকিন্তু নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর যে পরিমাণ পলি নদীগুলোতে যোগ হয় তা অপসারণ করতেই শতাধিক ড্রেজারের প্রয়োজন। মূল নদীর নাব্য বৃদ্ধি এবং তা রক্ষায় প্রয়োজন আরও শতাধিক ড্রেজার। অতীতে ধারাবাহিকভাবে এ কাজগুলো হয়নি বলেই নদীগুলোর আজ এ অবস্থা। তার পরও নদীর তীর রক্ষায় নানাবিধ পদক্ষেপ নিতেই হবে। জানা যায়, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নদীবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় দৌলতদিয়া প্রান্তে নদীর তীর রক্ষায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের নকশা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করে তা অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেই বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হবে। এতে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটসহ গোটা গোয়ালন্দ উপজেলা নদীভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দারা জানায়, নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য গ্রামের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত বস্নক ফেলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, যেখানে বস্নকের কাজ শেষ হয়েছে, তার পর থেকেই শুরু হয়েছে ভাঙন।
নদী খনন অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ কাজ। তার আগে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে দ্রম্নত ভাঙন প্রতিরোধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
দয়াল কুমার বড়ুয়া : কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা