সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজের বাজারে নিয়ন্ত্রক কে?

বাংলাদেশের ভারতীয় একচেটিয়া বাজারের নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বিকল্প আমদানি বাজার খোঁজাটা জরুরি।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রক হলো ভারত। অনেকেই সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন পেঁয়াজের মূল্য বাড়ার কারণে। সিন্ডকেটটি কেন তৈরি হয়। আসলে এই সিন্ডিকেট ভারত কর্তৃক সৃষ্ট, এই কথা বললে ভুল হবে না। রূপকথার গল্পে ডালিম কুমার ও কঙ্কাবতীর গল্পের কথা মনে আছে অনেকেরই। কঙ্কাবতীর প্রাণভোমরাটা বন্দি ছিল রুপার কৌটায়। কৌটাটা ছিল তালপুকুরের জলের গভীরের মাটিতে প্রোথিত। যাতে কেউ কৌটাটা নিতে না পারে তার পাহারা দিত এক রাক্ষস। ঠিক পেঁয়াজের বাজারটা পাহারা দেয় ভারত। তাই পেঁয়াজের মূল্যের ওঠানামা ভারতের ইচ্ছায়। ভারত ইচ্ছে করেই যখন তখন বাংলাদেশের বাজারের পেঁয়াজের মূল্য ওঠানামা করাতে পারে। এ দেশে সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম কমানো বাড়ানোর কাজ করলেও তার মূল প্রভাবক হলো ভারত। ভারতের মদতপুষ্ট এ দেশীয় ব্যবসায়ীরা এই কাজটি করে থাকে। সম্প্রতি ভারত ৩১ মার্চ, ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণাটা গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ামাত্রই পেঁয়াজের মূল্য ১০০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকা, কোনো কোনো জায়গায় আড়াইশ' টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। হঠাৎ দাম বাড়ায় বাংলাদেশের ভোক্তারা পড়ে বিপাকে। অন্যদিকে, দেখা যায়, ভারতীয় কৃষকরা বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় রাস্তায় মিছিল বের করে। ভারতীয় কৃষকদের দাবি ছিল বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করা হোক। বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশটিতে পেঁয়াজের মূল্য কমে যায়। ফলে ভারতীয় কৃষক পেঁয়াজের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। তাই ভারতীয় কৃষকদের দাবি বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানিটা অব্যাহত থাকুক। এতদ্‌সংক্রান্ত খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। এই দফায় ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার আগে কয়েক দফায় শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির বেলায় শুল্ক আরোপের হারটা এতই বেশি যে, যা দেশটির খোলাবাজারে বিক্রিত পেঁয়াজ বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কিনতে হয় দ্বিগুণমূল্যে। ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করাটা যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ পেঁয়াজের পচনশীল পণ্যে। তাই এই শুল্ক আরোপটা অনেকটা অবাক করার মতো বিষয়। ভারতের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৮-৪৬ টাকা, ৪০ শতাংশ শুল্কের জন্য তার ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায়। পরিবহণ খরচ লোড-আনলোড এসব ধরলে বাংলাদেশি আমদানিকারক প্রতি কেজি পেঁয়াজের ক্রয় করে থাকে ৬০ থেকে ৭৫ টাকায়। তাহলে তা খুচরা বাজারে কত টাকায় বিক্রি হবে? এই হিসাবটা পাঠকদের কাছে রইল। সরকারি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। কিন্তু পেঁয়াজ ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টন নানা প্রক্রিয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ ১৯ লাখ টন। বাংলাদেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। তাই ১১ লাখ টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। স্থানীয় উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে খুব একটা পিছিয়ে নেই। পেঁয়াজ উৎপাদনের শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশের স্থান সপ্তমে। তবে বাংলাদেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। পেঁয়াজ বাংলাদেশের খাদ্য প্রস্তুত তালিকায় অতি প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। তাই দেশের অভ্যন্তরে এর চাহিদা এতই বেশি যে, বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আর এই আমদানির পরিমাণও এত বেশি যে, পেঁয়াজ আমদানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের চাহিদার ৪০ শতাংশ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এই আমদানির ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ আসে ভারত থেকে। নেদারল্যান্ডস বিশ্বের ১৪০টি দেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করে থাকে। দেশটি পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম। হল্যান্ডের পেঁয়াজ সমিতির জার্নালে কয়েকদিন আগেও লেখা হয়েছে ভারতীয় পেঁয়াজের কারণে হল্যান্ড বাংলাদেশের মতো বড় পেঁয়াজের বাজার দখল করতে পারছে না। ডাচদের আফসোস বাংলাদেশ শুধু পেঁয়াজ আমদানিকারক দেশই নয়, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করে থাকে- যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ করে না। শুধু পেঁয়াজই নয়, বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম একটি বাজার। ভারত ডিম, রসুন, আদা, চাল, গরম মসলস্না, ফলসহ নানা ধরনের খাদ্য পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে থাকে। তবে একজন ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার যে বন্ধুসুলভ আচরণ করা উচিত, তা ভারত কতটা করে থাকে সেটি দেখার বিষয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের সংকট বা অভাব দেখা দিলেই ভারত সেই পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে তার মূল্য ছিল ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে মাত্র ১৯৯ কোটি ডলার। তবে দিন দিন ভারতে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণটা বাড়ছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই বাণিজ্য ঘাটতি কী এই পোশাক রপ্তানিতে দূর হবে।

চলমান এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পটি বাংলাদেশের কাজে লাগবে বলে অনেক অর্থনীতিবিদরা দাবি করে থাকেন। ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে খ্যাত দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় অনুন্নত সাতটি প্রদেশে যোগাযোগের জন্য এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পটি কাজ করছে। এর ফলে, ভারতের আইজল, গুহাটি, আগরতলা, ইম্ফল, শিলচর বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। চীনের একটি বড় অংশ এই করিডোরে সংযুক্ত হবে। তাছাড়া, সংযুক্ত হবে নেপাল ও ভুটান। বাংলাদেশের নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরটি পৃথিবীর এই অঞ্চলে অর্থনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযোজনা সৃষ্টি করবে। এই বন্দর ব্যবহার করার ফলে বাংলাদেশের আয় বাড়বে। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারত ও চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করে থাকে। তার মধ্যে প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ আমদানি করা হয় ভারত ও চীন থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এশিয়ান ইকোনমিকেল করিডোর স্থাপন হওয়ার ফলে কারা লাভবান হবেন বেশি? মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ভারত থেকে গরু বাংলাদেশিরা আমদানি করত। ফলে তখন বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম কম ছিল। মোদি ক্ষমতায় বসে বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে ভারতীয় গরুর মাংস প্রক্রিয়াজাত হয়ে ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। ভারতীয় চিকিৎসাসেবা ও পর্যটনের বড় বাজার হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০-১৫ হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। ভারত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স নিচ্ছে। এতগুলো সেবা নেওয়ার পরও ভারতীয়রা বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দেয় না। সংকটকালীন সময়ে ভারতীয়রাও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পরোক্ষ জোগানদার হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের ভারতীয় একচেটিয়া বাজারের নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বিকল্প আমদানি বাজার খোঁজাটা জরুরি।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে