সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং খাস জমি উদ্ধার তৎপরতা জোরদার হোক

বর্তমানে একটি শ্রেণি ইচ্ছেমতো ধানিজমি ব্যবহার করে ইটভাটা তৈরি করছে। একদিকে ইটভাটার মাধ্যমে স্থানীয় পরিবেশ নষ্ট করছে, অপরদিকে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকহারে ধ্বংস করছে।
মাহমুদুল হক আনসারী
  ০১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সরকারি খাস জমি ভূমিদসু্যদের নাগাল থেকে বের করে আনতে হবে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সরকারের হাজার হাজার একর খাস জমি ভূমিদসু্যরা জোর-জবরদস্তি করে দখলে রেখেছে। সরকারি এসব ভূমি দখলে রাখতে ভূমিদসু্যরা বিভিন্ন ধরনের সমিতি গঠন করে থাকে। ছিন্নমূল সমবায় সমিতি, মৎসজীবী সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সমিতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, অন্ধকল্যাণ সমিতি- নানা ধরনের নাম দিয়ে সরকারি খাস জমি দখল করতে দেখা যায়। এসব সমিতির পেছনে কতিপয় প্রভাবশালী মহল ইন্ধন দিয়ে যায়। প্রসাশনের বিভিন্ন সেক্টরের কর্তাদের সঙ্গেও তাদের যোগসূত্র পাওয়া যায়। জমি দখল করে সেখানে সাইনবোর্ড বসানো হয়। ঘর তৈরি করা হয়। পস্নট তৈরি করা হয়। নানাভাবে কৌশল করে ম্যাপ তৈরি করে এসব খাস জমি অপরাপর লোকজনের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হয়।

ভূমিদসু্য সিন্ডিকেট তারা খুবই শক্তিশালী। তাদের আছে অর্থ, জনবল, পেশিশক্তি এবং অস্ত্র। তারা যুব সমাজের একটি অংশকে ব্যবহার করে। প্রচুর অর্থ দুই হাতে খরচ করে খাস জমি দখলে রাখে। সশস্ত্র কর্মী বাহিনী গড়ে তুলে এসব জমির আধিপত্য রক্ষায়। তাদের শক্তির হাত খুবই লম্বা। যে কোনো ধরনের বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি থাকে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড জঙ্গল সলিমপুর অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত একটি এলাকা। পাহাড়-পর্বত ঘেরা এই এলাকাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি বলা চলে। কয়েকযুগ থেকে কয়েক কিলোমিটার এই এলাকার নান্দনিক সব সৌন্দর্য ও প্রকৃতি ধ্বংস করেছে ভূমিদসু্য বাহিনী।

কয়েকটি ভূমিদসু্য গ্রম্নপ একত্রিত হয়ে চৌদ্দশ একরের সরকারি ভূমি দখলে রেখেছে। চট্টগ্রামের মধ্যে এটি একটি শহরের মধ্যে ছোট শহর বলা যায়। ভূমিদসু্যরা এখানে ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। যাতে করে প্রশাসন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে না পারে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও রাতারাতি সাইনবোর্ড তৈরি করে নিজ দখলে নিয়ে নেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মার্কেট ও বাজার গড়ে উঠে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের লোকজন নিয়ে এসে উচ্চমূল্যে পস্ন্লট বা জমি বিক্রি করে দেয়। জমির দলিল দিতে ব্যর্থ হলেও স্স্নিপের মাধ্যমে জমি পস্নট হস্তান্তর করে।

ভূমিদসু্য এসব সিন্ডিকেট চট্টগ্রামের সরকারি খাস জমি এবং পাহাড়-পর্বত ধ্বংস করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে আসছে কয়েক যুগ থেকে। অতীতের কোনো সরকার বা প্রশাসন এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর উচ্ছেদ অভিযান দেখাতে পারেনি। সম্প্রতি প্রশাসন চট্টগ্রামের নান্দনিক পরিবেশ রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নদী ও পাহাড় রক্ষা করবে। পরিবেশবান্ধব পাহাড় ও ভূমি যেভাবে ছিল সেভাবে রাখার অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।

ইচ্ছে মতো পাহাড়-পর্বত নদী-নালা ধ্বংস করা যাবে না। চট্টগ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য যেভাবে আছে সেভাবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রামের জনগণ। ফলে চট্টগ্রামের সব শ্রেণির মানুষ তাদের সমর্থন জানিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক পাহাড়-পর্বত সরকারি জমি প্রশাসনের লোকজন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। ভূমিদসু্য গড ফাদার ইন্ধনদাতা সহযোগী এবং সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। দীর্ঘদিন পর হলেও জঙ্গল সলিমপুর সরকারের ছত্রছায়ায় আসায় স্থানীয় জনগণ সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

এই এলাকায় গড়ে উঠছিল দাগি চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা। এখানে দিনে রাতে তাদের নিজস্ব পাহারাদার চেকপোস্ট বসিয়েছিল। অপরচিত লোকজন সেখানে যাতায়াত করতে বেগ পেতে হতো। অতীতের কোনো সরকার স্থানীয় প্রশাসন সাহসিকতার সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে পারেনি। অদৃশ্য ইশারায় যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা নিমিষেই বন্ধ হয়ে যেত। এবারও সে আশঙ্কা অনেকেই করছিল। তবে আশার কথা হলো, এবারের প্রশাসন আন্তরিকভাবে সরকারি খাস জমি উদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিল। কয়েকটি সেবা সংস্থা যৌথ তৎপরতায় বিশাল জঙ্গল সলিমপুরের খাস জমি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

এখানে সরকারের পরিকল্পনায় যেসব সেবা সংস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে তা যেন সঠিক সময়ে হয়। নয় ছয় যেন না হয়। একটি পক্ষ থেকে নিয়ে আরেকটি অবৈধ পক্ষকে যেন হস্থান্তর করা না হয়। জানা যায়, এখানে অনেক জমি ভূমির মালিক ছিল কোটিপতি লোকজন। তাদের এক একজনের কয়েকটি করে পস্নট ছিল সেখানে। একর শতক পর্যন্ত মালিকানা ছিল অনেক শিল্পপতিদের। এ সব তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে নিশ্চয় আছে। কথা হলো, বাস্তবে কয়েকটি অসহায় ছিন্নমূল নিঃস্ব পরিবার থাকার তথ্যও সঠিক। প্রশাসনের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন প্রত্যাশা করছি। যারা বুক ভরা আশা নিয়ে একটি আশ্রয় স্থান পেয়েছিল তারা যেন আবার আশ্রয় হীন না হয়।

এ ধরনের বহু খাস জমি সারাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের সিটি এলাকায় রেলওয়ে, বন্দর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ নানা সংস্থার অসংখ্য জমি ভূমিদসু্যদের নাগালে পাওয়া যাবে। এসব জমিতে বাড়ি ঘর নির্মাণ মার্কেট প্রতিষ্ঠা করে ভূমিদসু্যরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। তারা শাসক দলের পদপদবি ব্যবহার করে এসব অপকর্ম ও ভূমি দখল করে রেখেছে। নদীর পারে নদী গ্রাস করে বহু প্রতিষ্ঠান মার্কেট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর এসব দেখেও কোনো আইনানুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।

বর্তমানে একটি শে্িরণ ইচ্ছেমতো ধানিজমি ব্যবহার করে ইটভাটা তৈরি করছে। একদিকে ইটভাটার মাধ্যমে স্থানীয় পরিবেশ নষ্ট করছে, অপরদিকে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকহারে ধ্বংস করছে।

কোনো কোনো এলাকায় শৃঙ্খলাহীনভাবে বাড়ি ঘর নির্মাণ ও দোকানঘর, মার্কেট নির্মাণ করে ধানিজমি ও ফসলি জমি অব্যাহতভাবে নষ্ট করা হচ্ছে। ইচ্ছে করে অধিক টাকা আয়ের জন্য এসব ধানিজমি নিয়মিতভাবে সারাদেশে শহর গ্রামে জমিগুলো নষ্ট করা হচ্ছে। ইটভাটার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা থাকলেও একটি মহল নানা কৌশলের মাধ্যমে ইটভাটার ব্যবহার করছে। ইটভাটার কারণে স্থানীয় ও বনভূমির গাছপালা কাটা হচ্ছে। ধ্বংস করছে গাছপালা জীববৈচিত্র্যের পরিবেশ। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে মাটি পোড়ানোর সংস্কৃতি পরিবেশ ধ্বংস গাছপালা রক্ষা করতে হবে।

এক কথায় সব ধরনের সরকারি খাস জমি রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নিঃস্ব অসহায় সম্বলহীনদের মাঝে বণ্টন করা যেতে পারে। কোনো অবস্থায় ভূমিদসু্য এবং রাষ্ট্রের সম্পদ লুন্ঠনকারীদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। সরকারি সব ধরনের খাস জমি উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা সহ জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ইটভাটার অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতা বন্ধ করা হোক।

মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে