শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বৈষম্য

গ্রেড পরিবর্তনের আগে, সম্মানের আসনটি ঠিক রাখা দরকার। সেই সঙ্গে সম্মানের অযোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিতের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়োগের সঙ্গে কারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নতুন বছরে কোনো ঊর্ধ্বতনের রক্ত চক্ষু আর বাক্যবাণে বিদ্ধ হবেন না কোনো শিক্ষক এই নিশ্চয়তা চাই।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ১১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সময় এগিয়ে যায়। পরিবর্তন আসে অনেক কিছুতেই। শিক্ষক নামক সম্মান, শ্রদ্ধার শব্দটি ধীরে ধীরে তার প্রকৃত অর্থ হারিয়ে অসম্মানের শেষ সীমায় অবস্থান করছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানবজাতির বৈশিষ্ট্য এবং মানবিকতার বিকাশেই কিছু সম্পর্ক তার সংরক্ষণ করা জরুরি। শিক্ষক শব্দের প্রতি শব্দ গুরু। মা, বাবা এবং গুরু। সেই প্রাচীনকাল থেকে এই তিন সম্পর্ক মানবজাতির জন্য কাছের, সম্মানের, মাথায় তুলে রাখার।

পৃথিবীর অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে সময়ের বিবর্তনে। মা, বাবা ও শিক্ষক এই সম্পর্ক এই শব্দগুলোর উপলব্ধি চিরকালই এক। একটি জাতির শিক্ষকের সম্মান, শিক্ষকের জীবনমান যদি তৃতীয় শ্রেণির থাকে তা হলে সে জাতি নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কী করে দাবি করতে পারে?

আমাদের উন্নয়নের সূচক উঠছে, সেই সঙ্গে উঠছে এ মানবিকতার সূচকও। একদিকে কানে ধরা, দিগম্বর করে ঘুরানো, লাথি মারা, পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনায় বাধ্য করানোসহ নানা অসম্মানে শিক্ষকের জীবন দুর্বিষহ, অন্যদিকে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীরা ধর্ষিত।

শিক্ষক শব্দের সঙ্গে সর্বদা সত্যের পক্ষে অবস্থান, সত্য তথ্য প্রদান, অন্যায়ের সম্মুখে মাথানত না করা, নির্ভীক, উন্নত শির এ ধরনের চিত্রই থাকা উচিত। কিন্তু প্রকৃত চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ দেশে শিক্ষক, বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক দেশের প্রতিটি মানুষের কাছাকাছি যায়। মানুষের আস্থা অর্জন করে। শিক্ষকদের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে যুগে যুগে শাসক শ্রেণি তাদের স্বার্থ অর্জন করেছে। শিক্ষকদের মুখ বন্ধ রেখে মেনে নিতে হয়েছে অন্যায়।

ব্রিটিশদের কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আমরা যে দীনহীন মানসিকতা লালন করছি আজও তা থেকে আমাদের উত্তোরণ ঘটেনি। বরং উন্নয়নের ফিরিস্তি নিয়ে আমরা যত সামনে যাচ্ছি ততই শিক্ষকদের অসম্মান, অপমানের মাঝে পৈশাচিক এক ধরনের আনন্দ অনুভব করছি। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুজনই মুখ্য। বাকি যারা আছে তারা গৌণ। শিক্ষকতা পেশা আর শিক্ষককে পাহারা দিতে, সহায়তা করতে যাদের বছর বছর নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তারা করেন চাকরি। চাকরির সঙ্গে চাকরের সম্পর্ক। পেশার সঙ্গে সেবার সম্পর্ক। সেই কাজলরেখা গল্পের দাসী হলো রানি আর রানি হলো দাসীর মতো। একদা অত্যাচারী শাসকও সেখানে শিক্ষাগুরুর সম্মুখে অবনত শিরে সম্ভ্রমে দাঁড়াতেন, এখন দেশের উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর অবলীলায় বলে, মাস্টাররা চোর। অবকাঠামোগত উন্নয়নে, আমাদের চোখের সামনে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘুণপোকার আক্রমণে অন্তঃসারশূন্য জাতির সম্মুখে আত্মমর্যাদাবোধহীন চোর, ধর্ষক, ঘুষখোর শিক্ষকের ধারণা। যে জাতির শিক্ষাগুরু চোর, সে জাতি কী করে সাধু হয়?

অত্যাচারী সব সময় অন্যকে পায়ের নিচেই রাখতে চায়। এটাই অত্যাচারীর বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যিনি পায়ের নিচে থাকে সে যদি মনে করে এটাই তার যোগ্য স্থান তখনই সমস্যা।

এক একটা সময় বিশেষ বিশেষ নামে পরিচিতি পায় ইতিহাসে। শত শত বছর পর এই সময়কে চিহ্নিত করা হবে 'মিথ্যা এবং অপমানের' যুগ হিসেবে।

মানুষ এখন কে কাকে কতটা অসম্মান, অপমান করতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মানুষের অপমানিত অবয়ব দেখে পৈশাচিক এক আনন্দ পায় অনেকেই।

গত ১০/১২/২০১৯ খ্রি. জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির পরিদর্শনে যান সোনাইমুড়ী উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ছনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের প্রতি তার বক্তব্য- 'তুই একটা মিথ্যাবাদী, তুই একটা চোর, তুই অযোগ্য প্রধান শিক্ষক, তোর উপজেলা শিক্ষা অফিসার একজন ঘুষখোর, তুই তাকে ঘুষ দিয়ে পদ বাড়ানোর ধান্দা করছিস- ইত্যাদি।' (মনিরুল হক বসুনীয়ার পোস্ট থেকে)।

খবরে প্রকাশ গত দু'বছর আগে এই মহান ব্যক্তি থানার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিদর্শন করতে গিয়ে সহকারী শিক্ষক মনির হোসেনকে তার বাক্যবাণ দ্বারা চরম অপমান করেন। অপমান সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই শিক্ষক। এক সপ্তাহ পরে তিনি মারা যান।

২০১৮ সালে শিক্ষকদের জারজ সন্তান বলে গালি দেন। ট্রেনিং চলাকালে একজন শিক্ষিকা ওয়াশ রুমে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি না দিয়ে বলেন, চেপে রাখতে।

এ রকম কর্মকর্তার সংখ্যা নগণ্য। তবুও তো আছেন। স্বপদে বহাল থাকার নৈতিক অধিকার এরা কি রাখে? ডিসির বেডরুমে পিএস নিয়ে কৃষ্ণ লীলার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল জনৈক ডিসির শিক্ষকদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পিটাতে চাইবার উদ্যত বাণী। এক মিটিংয়ে জনৈক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন ৫০০০ টাকায় আপনাদের চেয়ে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায়।

১০০ টাকায় রাস্তায় পতিতাও তো পাওয়া যায়। তাই বলে স্ত্রী আর পতিতা কি এক হলো?

কিছুদিন আগে আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকারা সভাপতির 'টর্চার সেলের' বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। জানা গেল তিনি প্রায়ই শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলেন।

কিছুদিন পর পরই দেখা যায়, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কর্তৃক শিক্ষক প্রহৃত। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা এখন আর অবাক হওয়ার বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। শিক্ষকের জন্য যে রাষ্ট্রে একের পর এক পাহারাদার নিযুক্ত করার প্রয়োজন হয় সে রাষ্ট্র কতটা দীনহীন তা কি বলার প্রয়োজন আছে?

বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য ড্রাইভারের নিচের স্কেলে বেতনের যে স্কেল সে অসম্মান থেকে মুক্তির জন্য বহু বছর যাবত প্রধান শিক্ষকের ১০ম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকের ১১তম গ্রেডের জন্য চলছে আন্দোলন। এসএসসি পাসের পর যারা ডিপেস্নামা করছে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আর মাস্টার্স কমপিস্নট করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এটা কি অন্যায় নয়? ২০১৭ সালে শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অনশন ভাঙিয়ে বলা হয়েছিল দাবি পর্যায়ক্রমে মানা হবে।

২০১৯ সালেও মানা হয়নি প্রতিশ্রম্নতি। বরং পুলিশের বুট আর লাথি জুটেছে কপালে। বাচ্চাদের কান্না, আবদার যেমন গুরুত্বহীন, তেমনি যে শিক্ষকরা তাদের শত শত বছরের ধারাবাহিক বঞ্চনার মুক্তির কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বুটের আঘাতে রক্তাক্ত হলো তাদেরও শিশুদের মতই গণ্য করা হলো।

মাননীয় মন্ত্রী মিডিয়ার সামনে বললেন, শিক্ষকদের ৩৬০০০ টাকা বেতন দেয়া হয়। তিনি ভুলে বললেও এটা তো ঠিক, তিনি বলতে চেয়েছেন এটাই হওয়া উচিত একজন শিক্ষকের শুরুর বেতন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে কতটা বরাদ্দ তার ওপরই নির্ভর করে দেশ কতটা শিক্ষাবান্ধব।

পুকুর খনন, এসি বসানো, আলু চাষ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে সরকারি কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতি বছর বিদেশে যাচ্ছেন। অথচ শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপনের জন্য, মৌলিক চাহিদা মিটাতে নূ্যনতম যে আর্থিক সুবিধা প্রয়োজন তা দিতে রাষ্ট্র অনিহা প্রকাশ করছে।

সমাজ ব্যবস্থায়, মানবিকতায় ভেতরে ভেতরে যে ভাঙন ধরেছে তার প্রমাণ মা-বাবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম এবং শিক্ষকদের জন্য নানা ধরনের আইন।

শিক্ষা ব্যবস্থার আগাগোড়াই নানা ধরনের অনিয়ম। এই অনিয়ম রোধের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম রয়েছে তা চিহ্নিত করা। শিক্ষকদের জন্য নানা ধরনের অসম্মানের ক্ষেত্র সৃষ্টি না করে দায়িত্বশীল, ন্যায়নীতি সম্পন্ন শিক্ষক সৃষ্টি করা জাতির স্বার্থেই প্রয়োজন।

তালেব মাস্টারের মতো শিক্ষক, যিনি গড়বেন ব্যারিস্টার অথচ তার ছেলে মরবে বিনা চিকিৎসায়, মেয়ে করবে আত্মহত্যা অনাহার থেকে মুক্তির জন্য। ইয়াদ আলীর মতো শিক্ষক, যার দু'চোখে স্কুল গড়ার স্বপ্ন, অথচ স্ত্রীর পরিধানে কাপড় নেই। শিক্ষকদের এ চিত্র এখন অনুপস্থিত। যুগে নির্যাতন, বঞ্চনা মানুষকে বাঁকা পথ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

শিক্ষক তার শত বছরের বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য নিত্যনতুন পথ সৃষ্টি করেছে। এই অবৈধ পথ দুয়েকজনকে অসম্মান করে, অপমান করে কি বন্ধ হবে? সবাইকে একইভাবে মূল্যায়ন করাও তো ঠিক নয়।

পৃথিবীতে এক একটা সময়কে ইতিহাস এক একটা নামে চিহ্নিত করেছে। বর্তমান সময়টা 'তেল আর মিথ্যে' হিসেবে চিহ্নিত হবে ভবিষ্যতে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে, কোথায় কী কী অনিয়ম তা চিহ্নিত করার জন্য গোপনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যেকের কাছে চিঠির মাধ্যমে সমস্যা এবং এর সমাধান জানা হোক। সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি। সর্বত্রই এই বালির তাপে জ্বলছে মানুষ। সুতরাং এদের চিহ্নিত করা হোক।

শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক, আদর্শ জীবনমান, শিক্ষকদের সন্তানের জন্য উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে সোজা পথ রেখে নিত্যনতুন বাঁকা পথ সৃষ্টি হবে। পাহারা দিয়ে এই বাঁকা পথকে সোজা করার দায়িত্ব যাদের ওপর দেয়া হবে তারাও অনেকেই মিশে যাবে ওই পথেই। সুতরাং পাহারাদার নিযুক্ত না করে, অসম্মান, অপমানকারীদের আস্ফালন বন্ধ করে শিক্ষকদের তাদের মর্যাদার আসনটি ফিরিয়ে দেয়া হোক।

গ্রেড পরিবর্তনের আগে, সম্মানের আসনটি ঠিক রাখা দরকার। সেই সঙ্গে সম্মানের অযোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিতের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়োগের সঙ্গে কারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নতুন বছরে কোনো ঊর্ধ্বতনের রক্ত চক্ষু আর বাক্যবাণে বিদ্ধ হবেন না কোনো শিক্ষক এই নিশ্চয়তা চাই।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83753 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1