শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

শুকদেব মজুমদার
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনার যে একটি ভৌম স্বরূপ রয়েছে, মুজিববর্ষে তা ক্রমশ উন্মোচিত হবে। এ প্রবন্ধ তারই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস, যার মুখ্য বিষয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার সর্বতোমুখী প্রভাব- বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিক ও রাজনৈতিক জীবনে, তাকে কেন্দ্র করে বাঙালির মনন-চেতনা, মুক্তি বা স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে। এ দেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদের এক জবরদস্ত নৌকোয় উঠিয়ে দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ২৪ বছরের ১২ বছরই জেলে থেকে বাঙালির ঐক্যের এক জলজ্যান্ত রূপ দেখে গেলেন শেষবারের মতো বন্দি হওয়ার আগে এবং সেই সময়েই স্বাধীনতার বাণীটি এমনভাবে রেখে গেলেন- যার দীপ্র প্রভাবে আগে থেকেই উন্মুখ হয়ে থাকা বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেয়া রক্তলোলুপ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দিকে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোচ্ছিলেন। যার ধারাবাহিকতার শেষে স্বাধীনতার দিগন্ত ছিল। সহসা তা পাওয়ার জন্য তিনি বিপস্নবী হয়ে উঠতে চাননি। যদিও তার আগুন তার মধ্যেই ছিল। জনগণের মধ্যে সে আগুন জমতে থাকুক- এমন তিনি চেয়েছিলেন বলে মনে হয়- যা সুযোগে স্ফুলিঙ্গ আকারে বের হয়ে আসবে। অনেক পরে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বানের মধ্য দিয়ে সে সুযোগ তিনি দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবর্ণ ফল পাওয়ার সময় যখন তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের দৌরাত্ম্যে সৃষ্টি হলো পাকিস্তান নামের ভূখন্ড। আসলেই কি দ্বিজাতিতত্ত্বের দৌরাত্ম্য ছিল, নাকি যতটা না ছিল তা, তার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছিল সাধারণ্যে এবং তার দ্বারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছিল? মূলে ছিল অনেকাংশেই বোম্বাইকেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলমান বেনিয়াদের বিরাট স্বার্থনির্ভর গভীর হিসাবনিকাশপূর্ণ ভাগবাঁটোয়ারার রাজনীতি। একই রাজনীতির সওয়ার পাকিস্তানি শাসকচক্রের নানা ছলচাতুরি জেল-হত্যা- শোষণ-নির্যাতনের হীন ঘৃণ্য ভয়াবহ লীলাখেলাই হলো পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের তাদের ইতিহাস। এ পুরো সময় জুড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের আক্রোশের শিকার হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির ঐক্যের মূল বটবৃক্ষের ছায়াতল। তার পেছনের কারণ হলো, সে ছায়াতল থেকে বাঙালিকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা, দলে ভেড়ানো; হিন্দু-মুসলিম বা বঙালি-বিহারিদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও বাঁধানো হয়েছে বারবার একই উদ্দেশ্যে। তার পেছনের বড়ো উদ্দেশ্য তো রয়েছেই- দুঃশাসনকে দীর্ঘায়িত করা। তাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের মধ্যে তীব্র দ্বিজাতিতত্ত্বের মনোভাব লালন করা, তা পালিত পাগলা কুকুরের মতো ছেড়ে দেয়া, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকে ক্রমাগত কামড়ে দেয়া, নব নব ফন্দিফিকিরে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়া, সবমিলিয়ে সমস্ত বাঙালিত্বকে চিরতরে দূর করে দেয়ার মনোভাব সর্বদা ছিল এবং সে অনুসারে কর্মকান্ডও তাদের দ্বারা চলছিল। ক্রমশ তাদের শাসন আর শোষণের তীব্রতা বেড়েছিল। এভাবে একাত্তরের যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বাঙালি আর অবাঙালির লড়াই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের লড়াই। একদিকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার ক্ষোভিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার-স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও লড়াই, অন্যদিকে বহুকালের সুবিধাভোগী অবাঙালি শাসক-শোষক শ্রেণির শাসন-শোষণ-নির্যাতন বজায় রাখার উন্মত্ত অমানবিক আকাঙ্ক্ষা ও তার ক্রূর বাস্তবায়ন। প্রথম পক্ষের প্রতিভূ ছিলেন বঙ্গবন্ধু, আর দ্বিতীয় পক্ষের আইয়ুব, ইয়াহিয়া। অবাঙালি ভরপুর মুসলিম লীগসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী দল, ব্যক্তিবর্গ দ্বিতীয় পক্ষে, আর প্রথম পক্ষের সবাই আওয়ামী লীগে একত্রিত। ন্যাপ ইত্যাদি ধারার রাজনীতিতে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ অর্থে একত্রিত হতে। সে দ্বিধাগ্রস্ততা, বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্যকে বঙ্গবন্ধু কখনো তেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কোনো দলকে বা কাউকে বিব্রত লজ্জিত করতে বা আরও বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে চাইতেন না। তার সহাবস্থানমূলক মনোভাব, বাঙালিসুলভ সহিষ্ণুতা ছিল উচ্চমাত্রার এ ক্ষেত্রে। কিন্তু যারা ঝরে পড়েছেন স্বেচ্ছায় নিজস্ব কোনো সীমাবদ্ধতায়, রাজনীতির জটিল চক্র যারা অনুধাবন করে উঠতে পারেননি, বা বাঙালির আন্দোলন ও ঐক্যের মহান সম্ভাবনায় যাদের বিশ্বাস ছিল না, যারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, তাদের জোর করে আনার চেষ্টা করেননি। কখনো তিনি 'একলা চলো' নীতিতে চলতেন। ছয় দফা নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন তিনি করেছেন- 'এ ধরনের সিদ্ধান্ত জুয়া খেলা' ইত্যাদির মতো কথাও না শুনে। ক্ষেত্রবিশেষে তার বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের কোনো ভুল বা অস্বাভাবিকতাকে ধরিয়ে দিতে পিছপা হননি। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর 'পিন্ডি যাইয়া লাভ আছে?'-এ কথা তাঁর না শোনার কথা মনে করা যেতে পারে (এম আর আখতার মুকুল, 'মহাপুরুষ,' পৃ. ৪৫); স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রীর, যিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন, ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন দেয়া উক্তিটির প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতিবাদ বা ক্ষোভের ব্যাপারটি। স্মরণ করা যায়, পাক-মার্কিন সামারিক চুক্তির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান, সোহরাওয়ার্দীর নমনীয় মনের পক্ষাবলম্বন না করে এ ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু প্রমুখের বিরুদ্ধাচরণ ও পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় সাংসদের বিবৃতি দেয়ার পথ ধরেই ১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী হন। উলেস্নখ্য, এ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে ২১ দফা দাবির ইশতেহার প্রকাশিত হয়, তাতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের কথা ছিল এবং বঙ্গবন্ধু রচিত 'কেন আমি অটোনমি চাই' নামের পুস্তিকায় বাংলার স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথাটি যুক্তিসহ উলেস্নখ ছিল। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতির শেষ সূক্ষ্ণ সুতোটি ছিন্ন হয়। পরে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির নব উন্মেষ ঘটে।

তার বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনোভাবটি আরো স্পষ্ট হতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার তৃষ্ণাও। 'মুজিব ভাই' থেকে ততোদিনে তিনি 'বঙ্গবন্ধু'। এর শুরুর সময়টায় এ প্রসঙ্গে একটু ফিরে যাওয়া দরকার। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর 'পাকিস্তানের একামাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'- এমন বক্তব্যে যে গুটিকয়েক ছাত্র আওয়াজ তুলেছিলেন এক কোণ থেকে, 'নো নো, উই ওয়ান্ট বেঙ্গলি' বলে, তাদের একজন হলেন বঙ্গবন্ধু, যিনি তারও আগে গণপরিষদে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাবটি বাতিল হওয়ার পরের দিনই ২৬ ফেব্রম্নয়ারি প্রতিবাদ মিছিলে সামনে ছিলেন। সেদিন গণপরিষদে বাঙালি মুসলিম সদস্যদের কেউ বাংলার পক্ষে মুখ খোলেননি। মুসলিম লিগের বাংলা ভাষাবিরোধী এ কর্মকান্ডে ১১ মার্চ যে ধর্মঘট পালিত হয়, যেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রধান একটি প্রণোদনা ছিল, তাতে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী প্রমুখ। দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় প্রথম ধর্মঘটেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি। মহান এ ভাষা আন্দোলনের ঘটনা বাঙালি জাতির মধ্যে যে উদ্দীপনা ঐক্য এনে দেয়, তা পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামকে সম্ভাব্য ও সফল করে তোলে ক্রমান্বয়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বলিষ্ঠতা সাধনের প্রথম বড়ো ধাপ হলো এ আন্দোলন। এ ২১ ফেব্রম্নয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইন পরিষদের সভা ঘেরাও করা যায় কিনা তা বিবেচনা করার কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জেলে আটক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি থাকার সময়ে। বাংলা ভাষার প্রতি তার এ ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা সারা জীবন অটুট ছিল। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা ও প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান করা হলে তীব্র প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ ত্যাগ করেছিলেন। মাতৃভূমির নাম বদল, বিশেষত তার 'বাংলা' শব্দটির প্রতি শাসকদের বিষনজর ও তার কর্তন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নামগত একীভূতকরণ তাদের চিরায়ত চক্রান্ত 'বাঙালিত্ব বিতাড়ন'-এর বিরুদ্ধে তার এ বিদ্রোহ নির্দ্বিধায় বলা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ। তার আগে পূর্বের প্রসঙ্গে আবার বলতে হয়, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ইলামিত্রের সাঁওতাল বিদ্রোহসহ নানা রকমের বিদ্রোহ, কমিউনিস্টদের বিপস্নব, গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, হত্যা, বন্দিহত্যা, আন্দোলনরত বাঙালি পুলিশদের হত্যা ইত্যাদি, তারপরে '৫২-এর ভাষা আন্দেলনে আবার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এরই মাঝে ১৯৪৯-এর ২৩ জুন বিশেষ একটি দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় বিশেষ কারো কারো মনে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে, যার যুগ্ম সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায়। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর দলের নামের 'মুসলিম' শব্দটি প্রত্যাহার করা হয়, নাম হয় 'আওয়ামী লীগ'। আবার সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু।

\হবাঙালি, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ইতিহাস আর বাংলার মাটির সঙ্গে তিনি ছিলেন 'সেন্টিমেন্টালি অ্যাটাচড'। এ প্রসঙ্গে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কারাগারে বসেও কারাবন্দিদের মধ্যে পারস্পরিক ফুল উপহার দেয়া-নেয়ার মধ্যে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযুক্ত করার ঘটনাটি স্মরণীয়। বাংলা নববর্ষ শুভেচ্ছাধারায় এই যে তার সংযুক্তি, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তার আন্তরিক সংযোগের সংবাদটি দিয়ে আমাদের সম্মোহিত করে (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২২৩)। সবচেয়ে বেশি সম্মোহিত করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী অশ্রম্নসিক্ত নয়নে আবেগাপস্নুত ভাষণটি, যেখানে বিজয়ী বাঙালির গর্বে বিশ্বকবির 'বঙ্গমাতা' কবিতার 'সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছ বাঙালি করে- মানুষ করনি'- লাইন দুটি উচ্চারণ করে কবির অভিমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাঙালি যে বিশেষ রূপেই মানুষ আজ তা উলেস্নখ করে তার বিমল আনন্দ লাভ করা, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি যে সাহস, সংগ্রাম, যোগ্যতা ও অর্জনে বেশ উচ্চস্থানেই অবস্থান করে তা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন। একেই বলে সেন্টিমেন্টালি অ্যাটাচড- আবেগাকুল আত্মিক সম্পৃক্ততা। বাঙালির সেন্টিমেন্ট বা প্রাণের স্পন্দন তিনি বুঝেছিলেন ও অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। অবশ্য তাদের কিছু বিশেষ চারিত্র্য বা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন, যেমন ছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কে (দ্রষ্টব্য, কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৮৯)। এ কারণেই তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে এমন ঋজু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, 'পোয়েট অব পলিটিক্স' অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। যে পলিটিক্স ছিল বাঙালির আত্মাগত ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির বিশেষ ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (দ্রষ্টব্য, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৯)। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পূর্ব পাকিস্তান সংগীতশিল্পী সমাজ আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন: 'ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার শামিল।' তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শুধু নয়, সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেছেন। বলেছেন: 'আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙালি, তারপর পাকিস্তানি। এ প্রসঙ্গে তার দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে বলেও তিনি তার দৃঢ় এক ইচ্ছার কথা জানান। যে ভাষার প্রশ্নেই বিদ্রোহী বাংলার প্রথম শরীরী রূপটি ফুটে ওঠে। বাঙালির স্বাধীনতামুখী সংগ্রামের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর এ। যদিও শক্তিশালী বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণি অধু্যষিত বাংলাদেশে বহুকাল থেকে কৃষক আন্দোলন, এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনও হয়েছে। বাঙালির এ অধিকারবোধ, রাজনীতি সচেতনতা ও সংগ্রামী ঐতিহ্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সজাগ ছিলেন, সে ঐতিহ্যকে একটি উচ্চতম রূপ দেয়ার জন্য তার রাজনীতি ও সংগ্রামকে চালিত করেছেন (দ্রষ্টব্য, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৪০)। আবারও বলতে হয়, এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে, সে রাজনীতি-সংগ্রাম বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষাকে অটুট রাখার ও বিকশিত করার এবং সে চেতনাসমৃদ্ধ নাগরিক গড়ার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষাকেন্দ্রিক ছিল। সংবিধানসহ কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনসহ আরো অনেক কিছুতে যার প্রভাব পড়েছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে। ৭ মার্চ ভাষণে যার পূর্বাভাসগত দীপ্তি রয়েছে। আর এক ভাষণে তিনি বলেছেন : 'আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ (৭ জুন ১৯৭২, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)।' কেবল বাঙালি জাতীয়তাবাদী নয়, এর সঙ্গে আরো ছিলেন তিনি; তার অন্য স্তম্ভ তিনটি হলো: ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। যা পুরো বাংলাদেশকেন্দ্রিক, তার আদর্শকেন্দ্রিক। যেখানে সবাই সমান, শোষণহীন, বঞ্চনাহীন থাকবে, মিলেমিশে পাশাপাশি, একটি অটুট দেশের ঐক্যময়, শান্তিময়, সমৃদ্ধিময় পরিবেশে। যে দেশের মাটি হবে সবার কাছে প্রাণের মাটি। যা তার কাছে ছিল। তিনি বলেছেন: 'আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো (আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন ভাষণে)।' তিনি এমন একটি কথা ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে কারামুক্তির পরেই জেলগেটেই আবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরে এক টুকরো মাটি কপালে ছুঁইয়ে বলেছিলেন। কথাটি হলো- 'হে মাটি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওরা যদি আমাকে ফাঁসি দেয় আমি যেন মৃতু্যর পর তোমার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারি (তোফায়েল আহমেদ, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অগ্নিঝরাদিনগুলি, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০)।' এ মাটি শুধু বাংলদেশের ভূমি নয়, বাংলার মানুষ, বাঙালি সত্তার প্রতিভূ। এমন করে মাটি ছুঁইয়ে দেয়া ও সে মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার ইচ্ছের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ ও দশের মঙ্গল আর অধিকারের জন্য চরম আত্মত্যাগী মনোভাবের সাক্ষাৎ লাভ করে অভিভূত হই। মাটিকে তিনি কখনো 'মা' বলেও সম্বোধন করেছেন (দ্রষ্টব্য, কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৫৬)। এ শব্দটি তার দেশপ্রেমিক সত্তার বিরাট অন্তর, আবেগ ও সততাগত মহিমাকে প্রকাশ করে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতার মহাসম্মিলনের সূতিকাগার এ শব্দটি, বড়বেশি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও বাঙালি সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদগত। বাঙালি সংগ্রামীদের কাছে এ 'মা' শব্দটি অত্যন্ত প্রিয়, অন্তরের-আবেগের শব্দ, শপথের শব্দ। এ মা, মাটি বা দেশলগ্ন মানুষের ভাগ্য নিজের ভাগ্য হিসেবেই তিনি সর্বদা দেখতেন। তাদের ভাগ্যহীনতা যেমন দেখতেন নিজের ভাগ্যহীনতা হিসেবে। এ প্রসঙ্গে কুর্মিটোলার দিকে ধবিত হওয়া প্রিজনভ্যানে বসে মনে মনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের কবরকে সালাম করে- 'চিরনিদ্রায় শুয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগ্য দেশবাসীর কথা!'

-এমন আফসোসের কথা উলেস্নখ করতে হয় (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৫৫)।

\হতিনি বিদেশের মাটিতে নয়, দেশের মাটিতে শাহাদতবরণ করেছেন সপরিবারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে, নিজ বাসভবনে, সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের হাতে। তাদের হত্যাকান্ড সমস্ত বাঙালির ললাটে অমোচনীয় কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে, বিষম অপরাধী করে গেছে সবাইকে। তাদের রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত উচ্চাভিলাষসহ একাত্তরের বিজয়ী বাঙালি একটি সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত জাতিতে পরিণত হোক, এমন আকাঙ্ক্ষা তাদের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকান্ডের পেছনে বিশেষ সক্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। একটি পরোক্ষ পাকিস্তান সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সফল হতে পারে বাঙালির আত্মবিস্মৃতির মধ্য দিয়ে- এমন হিসেব ছিল তাদের ওই সক্রিয়তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। এর বিপরীতে বাঙালির সক্রিয়তার, আত্মনিয়ন্ত্রণবোধের ও তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সর্বোত্তম বিকাশে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছিল তার মধ্যে একটি বৃহত্তম ব্যাপার ছিল বাঙালির বিমূর্ত কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুর বর্তমান থাকা। আর তা সম্ভব হয়েছে তার জন্মের জন্য। তার জন্মের শুভক্ষণটি থেকেই শুরু হয়েছিল বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও সাফল্যজনক ঘটনা একাত্তরের স্বাধীনতা লাভের দিন বা ক্ষণ গণনার শুরু- বাঙালির শিহরিত সাহসী গর্বিত অপেক্ষার পালা। বঙ্গবন্ধুর জন্মই ছিল আসলে বাঙালির ইতিহাসে শুধু নয়- বিশ্ব ইতিহাসের একটি উলেস্নখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। শততম ১৭ মার্চে, অর্থাৎ তার শুভ জন্মদিনে যে মুজিববর্ষ শুরু হলো, তার মধ্য দিয়ে সে ঘটনা আরো রটিত হবে সারা বিশ্বে, বিশেষত বাংলাদেশে তার স্বপ্ন-আদর্শের সঠিক ও সবিশেষ চর্চা ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে- এ হলো মুজিববর্ষের কামনা।

শুকদেব মজুমদার: কবি কলাম লেখক ও সহযোগী অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<87355 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1