চলছে ভাষার মাস। ভাষার মাস মানেই বইয়ের মাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা ও বই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ভাষার মাসে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০। তবে, সবচেয়ে বড় পরিসরে বইমেলা হচ্ছে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
অতীতের যে কোনো বছরের চেয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিসর এবার অনেক বেশি। এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে বইয়ের পাঠকসংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে।
এই যে পাঠকসংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ কী? এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, তরুণ সমাজের সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তারা বুঝতে পারছে, বন্ধু হিসেবে বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা থাকতে পারে কিন্তু বইয়ের তা নেই। তাই বই-ই মানুষের একান্ত এবং নিঃস্বার্থ বন্ধু। একটি ভালো বই-ই পারে মানুষের কুপ্রবৃত্তি দূরীভূত করতে। বইয়ের পাঠকসংখ্যা বাড়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, এ দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। ফলে আগে যেখানে অধিকাংশ তরুণ পড়তেই জানত না, এখন সেখানে প্রতিটি তরুণই প্রায় শিক্ষিত, সচেতন। আগে যেখানে দামি দামি গহনা দিয়ে আলমিরা সাজানো হতো, আজকাল সেখানে শিক্ষিত মানুষের ঘরে দামি দামি গহনার পরিবর্তে ভালো বই স্থান করে নিচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। অবশ্য অনেকেই মনে করেন ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় বইয়ের পাঠকসংখ্যা কমছে। আমি তা মনে করি না। যদি তাই হতো তাহলে, প্রতিবছর নতুন বই প্রকাশের পরিমাণ বাড়ত না, বাড়ত না মেলার পরিধি। শুধু পাঠকসংখ্যাই বাড়ছে তা নয়- পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে লেখক সংখ্যাও। বাংলা ভাষায় লিখিত বইয়ের মেলা আজকাল শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে তা নয়- বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে তা ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এই যে বইয়ের পাঠক বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, কিংবা বইমেলা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও হচ্ছে, এসবই খুশির খবর। এই খুশির খবরের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কিছু কষ্টদায়ক খবর দেখা যায়। এই যে, বইমেলায় বই আসছে, এই বইগুলো কীভাবে করা হয়। নিয়ম হচ্ছে, লেখক পান্ডুলিপি সাজাবেন। সেই পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশকের হাতে যাবে। প্রকাশক সেগুলো যাচাই-বাছাই করে মানহীন পান্ডুলিপি ফেরত দেবেন আর মানসম্মত পান্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করবেন এবং যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী লেখককে তার প্রাপ্য পাওনা প্রদান করবেন। এই তো। কিন্তু তা কি হচ্ছে? ডিজিটাইলাইজেশনের যুগে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল মানুষ অনায়াসেই নিজের মনের গহিনে লুকায়িত কথাটিও অন্যকে জানাতে পারছে নিঃসংকোচে, অনায়াসেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইদানিং অনেক লেখককে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন- প্রকাশকরা টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করছেন না, অনেক লেখক বিশেষত নতুন লেখক বিভিন্নভাবে প্রকাশক দ্বারা চরমভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক লেখক আমাকে জানালেন তার ভোগান্তির কথা। তিনি একটি প্রকাশনীতে বই প্রকাশ করার জন্য বলেছিলেন। প্রকাশক তার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা দাবি করেন। কিছুদিন পর এ প্রকাশক লেখককে বললেন, অতিরিক্ত আরও দুই হাজার টাকা দিতে হবে। দিলেন। কিছুদিন পর প্রকাশক তাকে বললেন, তাও হচ্ছে না, সব কিছুর খরচ বেড়ে গেছে। তাই আরও তিন হাজার টাকা দিতে হবে। অবশেষে তিনি মোট পনেরো হাজার টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেছেন। বিনিময়ে তিনি ১০০ বই পেয়েছেন। তাও অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে! আরেক লেখক জানালেন, তিনি তিন-চার বছর আগে বাংলা বাজারে এক প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। চুক্তি ছিল পনেরো হাজার টাকা দিতে হবে, মোট ৫০০ বই প্রকাশ হবে। ২৫০ লেখক পাবে, বাকি ২৫০ প্রকাশকের কাছে থাকবে। কিন্তু ওই প্রকাশক পরে তার কাছ থেকে আরও দুই হাজার টাকা নেয় অতিরিক্ত খরচের কথা বলে। সে যায় হোক। কথা ছিল, প্রকাশকের কাছে থাকা বইগুলো বিক্রি করে যে টাকা হবে তার একটি অংশ লেখককে দেয়া হবে রয়্যালিটি হিসেবে। লেখক আক্ষেপ করে জানালেন, ওই শেষ। এরপর প্রকাশক তাকে রয়্যালিটি দেবে দূরের কথা, লেখক ফোন করলে প্রকাশক বাজে ব্যবহার করেন। আরেকজন লেখক আছেন যিনি মোটামুটি জনপ্রিয়। তিনি অনেক দিন ধরে বই প্রকাশ করছেন। তিনি জানালেন তার আক্ষেপের কথা। বললেন, প্রকাশক আমাকে যে রয়্যালিটি দেয়, তা যৎসামান্য। এমনকি বইমেলায় কত কপি বই বিক্রি হলো তার সঠিক হিসাব নিয়েও প্রকাশকরা লুকোচুরি করে। সরকারি বেসরকারি প্রজেক্টে আমার কত কপি বই কখন নিল এই হিসাবও প্রকাশক দেয় না। রয়্যালিটির স্স্নিপে অন্যের স্বাক্ষর করে লেখকের স্বাক্ষর বলে চালিয়ে নেয়। আপনি কোনো ব্যবস্থা নেন না কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে লেখকরা প্রকাশকদের কাছে জিম্মি। প্রকাশকরা এক ধরনের টাউট। এদের সঙ্গে চাপাচাপি করলে বরং নিজেরই মান যাবে। আমরা লেখকরা যে এর জন্য একদমই দায়ী না তা নয়, অনেক লেখক আছেন যাদের লেখা একদমই মানসম্পন্ন নয়, কোনো জাতীয় এমনকি স্থানীয় কোনো পত্রিকায় এদের একটি লেখাও ছাপা হয়নি। এমন লেখকও চায় তার একটি বই বের হোক। যে কোনো উপায়ে। টাকার বিনিময়ে হলেও। আবার অনেক অতিউৎসাহী ব্যক্তি রয়েছেন যারা তাদের আদুরে স্ত্রীর প্ররোচনায় স্ত্রী কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ের নামে একটি বই হোক-এমনটা চায়। আর এই সুযোগটাই নেয় ওই সব অসাধু প্রকাশকরা। এই হলো তিমির রাতের হতাশার কথা। এবার আলোর ফেরিওয়ালাদের প্রসঙ্গে আসি। লক্ষ্য করেছি, অনেক প্রকাশক তাদের পোস্টে জানিয়েছেন তারা টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করেন না। মানসম্পন্ন পান্ডুলিপি পেলে তারা নিজেদের বাজেটে বই প্রকাশ করেন। এগুলো উৎসাহব্যঞ্জক খবর। জানিয়ে রাখি এবছর আমার দুটি ছোটদের বই বেরুচ্ছে। একটি 'শিয়াল পন্ডিতের লোকসান' আরেকটি 'কাক ছানার অভিমান'। প্রকাশনী যন্তর মন্তর। এই প্রকাশনীর মালিক আমাদের ময়মনসিংহের মাহমুদ বাবু। তিনি আমার এই বই দুটি সম্পূর্ণ প্রকাশনীর খরচে বের করছেন। শুধু তাই নয়- তিনি গত বছরের মাঝামাঝি আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, 'মাঈন উদ্দিন ভাই, আপনার জানা মতে যারা ছোটদের জন্য মানসম্পন্ন লেখা লেখেন বিশেষ করে জাতীয় পত্রিকায়, তাদের লেখা আমাকে দিন।' আমি নিজ দায়িত্বে সোহেল রানা ভাই ও আব্দুল সালাম ভাইকে (যারা বর্তমানে বিভিন্ন পত্রিকায় শিশুদের গল্প লিখছেন) ফোন দিয়ে পান্ডুলিপি দিতে বলি। তাদের বই প্রকাশ হচ্ছে। ফারুক হোসেন সজীব ভাইকে বলি, তিনি জানিয়েছেন, বই প্রকাশের জন্য তিনি যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। শুধু উলিস্নখিত লেখকদের নয়, সেলিনা হোসেন, আহসান হাবীব, আলী ইমামদের মতো প্রবীণ লেখকসহ মনোয়ার হোসেন এবং মুহাম্মদ অংকনের মতো ১৫-১৬ জন নবীন লেখকদের বই করছেন এই গুণী প্রকাশ নিজ খরচে। তাই আমি বলতে চাই- অনেক স্বনামধন্য প্রকাশনী নিজ খরচে মানসম্মত বই বের করে অনেক নতুন লেখক সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন। অন্যদিকে এও জানি, অনেক প্রকাশক মানসম্মত/মানহীন পান্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করতে লেখকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। তারা লেখকদের ছাঁই দিয়ে ধরে বাইন মাছের মতো চামড়া ছিঁড়ে নেয়। ক্ষেত্রবিশেষে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করে না। আমি মনে করি বই প্রকাশের ব্যাপারে লেখকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত, বিশেষ করে নতুন লেখকদের। সেই সঙ্গে বাংলা একাডেমির উচিত কোনো প্রকাশক যেন মানহীন বই ছাপাতে না পারে এবং লেখকরা যেন সত্যিকার অর্থেই প্রাপ্য রয়্যালিটি পায় এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মো. মাঈন উদ্দিন: কলাম লেখক