শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লকডাউন ও পূর্বাপর

কজন মানুষের ঘরে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে? আর ওরা সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানবেই বা কী করে, এক একটা খুপরি ঘরে থাকে ছয়-সাতজন করে মানুষ। সোশ্যাল ডিসট্যান্স কথাটি তাদের জীবনে এক মারাত্মক পরিহাস।
আফরোজা পারভীন
  ২৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

অদ্ভুত একটা সময় পার করছি আমরা। দিন তারিখের হিসাব নেই কারো। মাসাধিককাল জুড়ে লকডাউন চলছে। মেয়ে আর বৌমার অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। ছেলের সু্যটিং নেই। বাড়ির অভিভাবক আমারও চিন্তা নেই, ওরা কী খেয়ে যাবে। ফিরতে দেরি হলে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা নেই। বদ্ধ ঘরে বন্দি আমরা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গে দেখা করার উপায় নেই। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এখন আর ভয়ে টিভি দেখি না। সাধারণ মৃতু্যর হারও বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই চেনা জানা কারো না কানো মৃতু্য সংবাদ শুনছি। সারাটাক্ষণ গুমরে আছি আর ভাবছি, আর কি কোনোদিন আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব! করোনাভাইরাসমুক্ত পৃথিবীর সতেজ আলোয় শঙ্কাহীন মনে ঘুরতে পারব! জানি না। বিধাতা জানেন!

করোনার মধ্যে জাতির জীবনে ঘটে গেল একটা অনেক বড় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ ধরা পড়ল, তার ফাঁসিও কার্যকর হলো। এই লোকটির কাছে শিশু রাসেল পানি খেতে চেয়েছিল। দেয়নি সে। বরং দিয়েছে এক ঝাঁক বুলেট। এরা করোনার মতোই ভয়ঙ্কর। দীর্ঘদিন ভারতের কলকাতায় পালিয়ে ছিল সে। সেখানে বিয়েও করেছে। সন্তানও আছে। সুদের কারবারও করত। বোলবালা ভালোই ছিল। ২৫ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিল। শোনা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক খুনি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনও ধরা পড়েছে। কথা সত্যি হলে করোনাকালে এ দুটি জাতির জীবনে অনেক বড় ঘটনা।

অনেক অমানবিকতার চিত্রও আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত। করোনাক্রান্ত রোগীকে ব্যাগে ভরে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালে করোনায় মৃত বাবাকে নিয়ে যায়নি ছেলে। নিয়েছে তার ডেথসার্টিফিকেট। কারণ এটা ভবিষ্যতে তার কাজে লাগবে। ওই ছেলে কি জানেন তিনি নিশ্চিত বেঁচে থাকবেন? করোনা তাকে ছোঁবে না? হঁ্যা এই নিষ্ঠুরতা ক্ষমার অযোগ্য। আমরা মানুষের এই নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলতেই পারি। আপনজনের কাছ থেকে এটা কাম্য নয় মোটেও। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। মানুষ মাত্রই বাঁচতে চায়, এটা সহজাত প্রবৃত্তি। আর সেই বাঁচার তাগিদেই মানুষ এটা করছে। এই কাজটা কোরিয়ানদের গুলি করে মারার চেয়ে কম নৃশংস নয় কোনোক্রমেই।

সুজাতা আর রতন চৌধুরী আমেরিকা গিয়েছিলেন উন্নত জীবনযাপনের আশায়। ভালোই ছিলেন তারা। একদিন নিজের অজান্তেই কাজের জায়গা থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে ঘরে ফিরলেন সুজাতা। একে একে সংক্রমিত হলো স্বামীসহ দু'সন্তান। চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ঘরেই চিকিৎসা নিতে বলা হলো তাদের। স্বামী মারা গেছেন। আমেরিকার মতো উন্নত দেশ লাশ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা রতনের মৃতদেহ নিয়ে যেতে পারেনি। বাড়িরই একটা ঘরে ব্যাগ বন্দি করে ঘরে তালা দিয়ে রেখে গেছে। কিছু লাশ মাটি চাপা দেয়া হলে লাশ নিয়ে যাবে বলে গেছে। ভাবা যায় কত মর্মান্তিক বিষয়! পাশের ঘরে মৃত স্বামী আর পিতাকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন সুজাতা আর বাচ্চারা। সত্যি কাঁদতেও ভুলে গেছি।

উন্নত দেশে যখন এই অবস্থা, করোনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো; তখন আমার দেশে ঘটছে একের পর এক অবাঞ্ছিত ঘটনা। সর্বকালের স্মরণীয় আর ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন পোশাক খাত নেতারা। আমার প্রশ্ন করোনা কি পোশাক শ্রমিকদের ত্যাজ্য করেছে। করোনা যদি পোশাক শ্রমিকদের ত্যাজ্য করে থাকে, ছোঁবে না বলে থাকে তাহলে কোনোই সমস্যা নেই। দলে দলে আসুক গায়ে গা লাগিয়ে, হাঁচি-কাশি-থুতু গায়ে মেখে, ছিটিয়ে। আসুক হেঁটে গড়িয়ে হেঁচড়ে। আসুক ট্রাকে, ফেরিতে, বাসের হাতল ধরে। আসুক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অসুস্থ পুরুষ, ভীত যুবক, কম্পিত নারী। আসুক খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ থেকে। ওরা আসুক দলে দলে কাতারে কাতারে। করোনা ওদের ছোঁবে না, ত্যাজ্য করেছে যে!

ব্যাপারটা যদি তেমন হতো আমরাও নিশ্চিন্ত হতাম। যদি জানতাম সারা পৃথিবীতে এত মানুষ যে করোনায় আক্রান্ত হলো, মারা গেল, ধুঁকছে তাদের মধ্যে একজনও কি পোশাক শ্রমিক নেই? আপনাদের জানা আছে কি, কোনো পোশাক শ্রমিক নেই?

অন্যদিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বেড়তলা গ্রামে মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় সমবেত হয়েছে লাখো লাখো মানুষ। কোথায় সোশ্যাল ডিসট্যান্স, কোথায় মাস্ক, কোথায় গস্নাভস। ধর্মের প্রসঙ্গে এলেই মানুষ চুপসে যায়। ভয়ে কথা বলতে পারে না। প্রশাসন পড়ে বেকায়দায়। এ ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারায় ওসি প্রত্যাহার হয়েছেন। লকডাইন করা হয়েছে আশপাশের ৮টি গ্রাম। এটা কি কোনো সমাধান! জানা যায়, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হয়েছে এ জমায়েত। মানুষ যদি বিশ্বাস না করে সচেতনতা দরকার দু'চারজন ওসি কী করবে। ক'জনকে ঠেকাবে! ওই যে অসংখ্য মানুষ সমবেত হলো ওদের মধ্যে কতজনের যে করোনা ছিল কে জানে! তাদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে কত মানুষ তাই বা কে জানে!

এদিকে পত্রিকায় এসেছে লক্ষ্ণীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের পিতা মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর জানাজায় গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে হাজারখানেক লোক জড়ো করা হয়। যদিও গণজামায়েত নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সেই নিষধাজ্ঞা মানলেন না সরকার দলীয় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। না মেনে পিতার জানাজায় ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটালেন। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, নুরউদ্দিন চৌধুরীকে জনজমায়েত না করে সীমিত পরিসরে জানাজার আয়োজন করার জন্য বলা হয়েছিল। এর আগে একই জেলার রায়পুর উপজেলায় করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য গণজমায়েত করা হয়েছিল।

করোনা আক্রান্ত দেশে চাল, গম, তেল, মাস্ক ও গস্নাভস চুরি হচ্ছে। হতদরিদ্র মানুষরা সামান্য কিছু ত্রাণের আশায় সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, এখানে ওখানে দৌড়ায়। করোনার ভয় তাদের ভীত করে না, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, মাস্ক ও গস্নাভস কিছুই তাদের মনে থাকে না। তারা দৌড়ায় পেটের ক্ষুধায়। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ ক্ষুধা আছে। আর এই চোরগুলো বক্সখাটে তেল লুকায়, মাটির নিচে চালের বস্তা লুকিয়ে রাখে। কত উৎকৃষ্ট এদের ব্রেন। পাক্কা চোর না হলে বক্সখাটে তেল লুকানোর কথা কারো মাথায় আসে! চাঁদপুরের এক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান চাল চুরি করেছেন। তার ঝকঝকে চেহারা দেখলে মনে হয় না তিনি চুরি করতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলার যে ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে তা দেখে মনে করা কঠিন এই মহিলা চোর। উনি নাকি বলছেন, সরলমনে রেখেছে। এ চাল কি রাখার জন্য? এ চাল বিতরণের জন্য। গরিবের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর চাল থাকবে গোডাউনে, নিজ বাড়িতে কেন?

দুঃখজনক ব্যাপার, সরকারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কতিপয় ব্যক্তির নামে নিম্নমানের গস্নাভস বাজারজাতকরণের অভিযোগ উঠেছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে একজন বলেছেন, ভুল করে ভুল মাস্ক দেয়া হয়েছে। ওনারা ভুল করে ডাক্তারদের জীবন নিয়ে খেলতে পারেন না। এ ঘটনা চাল তেল চুরির চেয়েও মারাত্মক। পয়সা কামানোর জন্য মানুষকে নিশ্চিত মৃতু্যর দিকে ঠেলে দেয়ার পন্থা।

\হচোররা দেশব্যাপী বিস্তৃত। সব জেলা, উপজেলা, সব ইউনিয়নে এরা সদর্পে আছেন। ত্রাণের চাল, টিসিবির ১০ টাকা কেজির চাল, তেল সবই এরা দুহাতে লুটছেন। ইতোমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, জরিমানা হয়েছে, জেল খেটেছেন, ডিলারশিপ বাতিল হয়েছে। চুরি করলে ভবিষ্যতে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না এমন ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু 'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী'। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সারাদেশে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু ওদের যা করার তা করছে। জাতির জনক দুঃখ করে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে চোরদের। সেই চোররা বংশবিস্তার করে ডাল পালা ছড়িয়ে দেশ ভরে ফেলেছে।

সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। দরিদ্র নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির মানুষের কথা ভেবেই এ প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে সরকার। যেভাবে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা যদি সঠিকভাবে বণ্টত হতো তাহলে মানুষের এত খাদ্যাভাব, মানুষের ঘরে ঘরে এত হাহাকার থাকার কথা না। কিন্তু সঠিক বণ্টন হচ্ছে না। রাঘববোয়ালরা সব খেয়ে ফেলছে। সে কারণে আমরা খবরে পড়ছি খেতে না পেয়ে রিকশাওয়ালা মারা যাচ্ছে, মা খাবার না দিতে পেরে সন্তানদের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ত্রাণের দাবিতে জনগণ মিছিল করছে। ট্রাক থেকে ত্রাণের চাল কেড়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া তাদের উপায়ও নেই। এ চাল যে তারা পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সরকারের তরফ থেকে অব্যাহতভাবে বলা হচ্ছে সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানার জন্য, ঘরে থাকার জন্য, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য। কিন্তু এক শ্রেণি মানছেন না মজ্জাগত প্রবণতার জন্য। আরেক শ্রেণি ক্ষুধায়। আমার এক আত্মীয় মারা যাওয়ায় কাল বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। দেখলাম ত্রাণের গাড়ির সামনে দীর্ঘলাইন। জানি না, এসব মানুষ ত্রাণ পাবে কি না।

পরিস্থিতি যখন এই, তাহলে কী প্রয়োজন এই লকডাউনের! আমরা দিনের পর দিন লকডাউনে থাকছি, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছি আর একদল মানুষ যা ইচ্ছা তাই করছে ধর্মের নামে, ক্ষমতার দাপটে। আর অন্যদিকে গরিব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ঘরবন্দি হয়ে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে।

কজন মানুষের ঘরে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে? আর ওরা সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানবেই বা কী করে, এক একটা খুপরি ঘরে থাকে ছয়-সাতজন করে মানুষ। সোশ্যাল ডিসট্যান্স কথাটি তাদের জীবনে এক মারাত্মক পরিহাস।

এক দেশে তো দুরকম আইন হতে পারে না। হয় কঠোরভাবে লকডাউন পালিত হবে, সবাই ঘরে থাকবে, গরিব মানুষের ঘরের দোয়ারে ত্রাণ পৌঁছে যাবে। প্রয়োজনে কার্ফু জারি হবে। নতুবা তুলে নেয়া হোক লকডাউন। সবাই সাবধানতা সচেতনতা নিয়ে বাঁচুক।

আফরোজা পারভীন: কথাশিল্পী, কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<97552 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1