শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্রসম্পদ আহরণে পিছিয়ে বাংলাদেশ

আলতাব হোসেন
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
গভীর সমুদ্র থেকে তেল ও গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ আহরণে ব্যবহৃত বিশেষ স্থাপনা -ফাইল ছবি

সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সমুদ্র সম্পদ আহরণে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা তাদের সমুদ্র সম্পদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত করছে। তেল ও গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ তুলছে তারা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ এখনও পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে। সমুদ্রসীমার ৮০ ভাগ এলাকার নীল জলরাশির তলদেশে কী বিশাল সম্পদ লুকিয়ে আছে, তা এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারেনি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা তাদের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার শুরু করেছে। মিয়ানমার তাদের গ্যাস বস্নকগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। 'থালিন-এক' নামক বস্নকে প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার। ওই বস্নক থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে মিয়ানমার। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে হাত গুটিয়ে বসে নেই ভারত। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিন এলাকায় ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি গ্রম্নপ রিলায়েন্স কোম্পানির অনুসন্ধানে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদের আশা করছে ভারত।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, শুধু দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিশাল সমুদ্রসীমা জয়ের পরও বস্নু ইকোনমির সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না। ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'বস্নু-ইকোনমি সেল' গঠন করা হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, পর্যাপ্ত জাহাজ ও উন্নত প্রযুক্তির অভাবে সমুদ্রসীমার ৬শ' কিলোমিটারের মধ্যে মাছ ধরা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারে। দেশের সমুদ্রসীমায় আশি লাখ টন মাছের মজুত থাকলেও দেশের জেলেরা ধরে মাত্র সাত লাখ টন মাছ। সমুদ্রে মাছ আহরণ বাড়াতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের মধ্যে 'টেকসই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ' শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদপ্তর।

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে জলরাশির সুবিশাল এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে ছয় বছর আগে। বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও মহীসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত করে আদালতের রায়। যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারে বাংলাদেশকে এখনও যেতে হবে বহুদূর। সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের অধিকাংশ সম্পদ ভাসমান। দ্রম্নত এই সম্পদের ব্যবহার না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের নিচে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুত রয়েছে। অথচ এখনও জরিপ করতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা তেল ও গ্যাসের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলীয় এলাকায় অনেকগুলো বড় গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশ অংশেও রয়েছে এর সম্ভাবনা। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাব এবং তথ্যের অপ্রতুলতার অভাবে সমুদ্র সম্পদের হিসাব এখনো অজানা। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সামুদ্রিক সম্পদ জরিপ ও সম্পদ আহরণ জরুরি। বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতে সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে।

সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের সুবিশাল জলরাশির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির এক অপার সম্ভাবনা। যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বস্নু ইকোনমি নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে। আটটি দেশ মিলে বে অব বেঙ্গল প্রকল্প করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। তবে সবকিছুই এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১০০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে। তাছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই হাজার ৬০০ জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ছয় বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি এবং মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানায় প্রায় ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। সামুদ্রিক সম্পদের এক বিশাল আধার হচ্ছে বঙ্গোপসাগর।

বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ইউরেনিয়াম, পস্ন্যাটিনাম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, জিঙ্ক ও সালফাইড, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ও মহামূল্যবান ধাতু রয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সেভ আওয়ার সি'র তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি আছে। মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লাখ জেলের জীবিকার উৎস্য সমুদ্র।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, সামুদ্রিক বিশাল সীমারেখা জয়ের পর সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন হাতছানি দিচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হতে পারে বস্নু-ইকোনমি। বস্নু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, সমুদ্র বিজয় নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতি অর্জন ঘরে তুলতে তেমন উদ্যোগ নেই। সাগরে মাছ অনুসন্ধানের জন্য একটি জাহাজ কেনা হলেও সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধানের জন্য কোনো জাহাজ নেই। সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে বছরে দুই লাখ কোটি ডলার আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সাইন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল হোসেন বলেন, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। খুলে দিতে পারে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে হলে সমুদ্র গবেষণায় গতি বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্রের নীল জলের পরতে পরতে অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা এখনও আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। সমুদ্রের টুনা জাতীয় মাছ আহরণ এখনও সম্ভব হয়নি।

সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. দিলরুবা চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ সমুদ্র সম্পদ আহরণে পিছিয়ে আছে। অফুরন্ত সম্পদ লুকিয়ে আছে আমাদের সমুদ্রে। তেল ও গ্যাস ছাড়াও আছে বিপুল সম্পদ।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, 'দ্য সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সংরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকা' প্রতিষ্ঠা করে, যা তিমি, ডলফিন, সামুদ্রিক কচ্ছপ, হাঙ্গর ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। তবে সামুদ্র্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করলেই হবে না, সমুদ্র সম্পদ সুরক্ষা ও ব্যবহারে সবাইকে নিয়ে একটি কর্ম-পরিকল্পনা করতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম) ও বস্নু ইকোনমি সেলের উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশিদ আলম বলেন, সমুদ্রসম্পদ নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য আছে। সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে নিয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। সমুদ্র অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্যসম্পদ ছাড়াও বাংলাদেশের সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকা তেল ও গ্যাসের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা ২০৩০-এর অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ সাগর, মহাসাগর ও সমুদ্রসম্পদেও টেকসই এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। আগ্রহ প্রকাশ করছে জাপান। দেশের বস্নু ইকোনমি খাতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করতে আগ্রহী ফ্রান্সের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিএলএস। শিগগিরই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে বস্নু ওশান ইকোনমি বা নীল সমুদ্র অর্থনীতি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112661 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1