শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা নিয়ন্ত্রণে এলোমেলো সিদ্ধান্ত, বাড়ছে বিভ্রান্তি

সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আসন্ন শীতে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ (সেকেন্ড ওয়েভ) লাগতে পারে, এমন আশঙ্কায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার জোর তাগিদ দিয়েছিলেন। ফার্স্ট ওয়েভের চেয়ে সেকেন্ড ওয়েভ আরও ভয়াবহ হতে পারে বলেও তারা সতর্ক করেছিলেন। গত রোববার খোদ প্রধানমন্ত্রীও একই ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। অথচ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিনটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। আরও প্রায় একডজন হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রয়েছে।

অন্যদিকে বেশ কিছুদিন আগেই কোভিড-১৯ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কৌশলে কমিয়ে আনা হয়েছে নমুনা পরীক্ষাও। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ক্ষেত্রেও চরম শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। ফলে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

অনেকেই মনে করছে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে দ্রম্নতগতিতে কমতে শুরু করেছে, তাতে শিগগিরই তা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। এ ব্যাধিতে মৃতু্যর হারও সহসাই হ্রাস পাবে। আবার কারও কারও ধারণা, প্রাণঘাতী করোনা এরই মধ্যে যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই এতে আক্রান্ত হলেও ভয়ের কিছু নেই। ঘরে থেকে ক'দিন সাধারণ চিকিৎসা নিলেই তা সেরে যাবে। ঘর থেকে বের হলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও এ কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। অফিস-আদালতসহ সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ঢিলেঢালা। ফলে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ লাগার আশঙ্কা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিভ্রান্তি।

উদ্বিগ্ন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রশাসনের বেশকিছু সিদ্ধান্তে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে তারা সরকারকে আগেভাগেই সতর্ক করেছিলেন। অথচ তাদের সে পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া করোনা নিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময় যেসব মন্তব্য করেছেন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে বলেও মনে করেন তারা।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ আগস্ট শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'আমরা খুবই আনন্দিত যে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। মৃতু্যর হারও কমেছে, সুস্থতা বেড়ে গেছে। বেশিদিন লাগবে না বাংলাদেশ থেকে কোভিড চলে যাবে, ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কি না জানি না।' এছাড়া করোনায় মৃতু্যর হার জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম ও সুস্থতার হার বেশি এবং হাসপাতালের ৭০ শতাংশ বেড খালি থাকা নিয়েও আত্মতুষ্টি প্রকাশ করেন মন্ত্রী।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, করোনা মোকাবিলায় একের পর এক এলোমেলো সিদ্ধান্তের কারণে নানা সংকট তৈরি হলেও তাদের পরামর্শ বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির দিকনির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে। গত সাত মাসে তারা ২৯টি সুপারিশ করলেও তার মাত্র একটি পূর্ণাঙ্গভাবে মানা হয়েছে।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক সদস্য বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান মেনে কমিটি পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু যারা বাস্তবায়নের দায়িত্বে তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। অন্যদিকে প্রশাসনে যারা আছেন তারা জনকল্যাণের চেয়ে সব কিছুর ওপরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাটাই মূল লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া করোনা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের মারাত্মক অভাব রয়েছে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, শুধু কমিটির সুপারিশই অবজ্ঞা করা হয়নি; উল্টো স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন কমিটিকে অবহিত না করেই করোনা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় আরোপিত নানা বিধিনিষেধ অবৈজ্ঞানিকভাবে শিথিল করেছে ও নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে স্থানীয় সংক্রমণ কমিউনিটিতে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে। জনমনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

এদিকে আসন্ন শীতে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ লাগতে পারে এ আশঙ্কা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা যে দাবি করছেন, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। তারা মনে করেন, সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের হুঁশিয়ারি এবং প্রস্তুতির কথায় ফারাক রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রথমদিকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি থাকার কথা শোনা গেলেও এ মহামারির আকার নেওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা থেকে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এখন এ বিষয়ে প্রস্তুতিও যেন শুধু 'ফাঁকা আওয়াজ' না হয় সরকারকে তা লক্ষ্য রাখতে হবে। শীতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যথেষ্ট সক্ষমতা আছে কি না তা নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, দেশে বর্তমানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কম দেখা গেলেও করোনা সংক্রমণ আদৌও কমেছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। তার ভাষ্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী, ঊর্ধ্বমুখী বা একই ধারায় প্রবাহমান- এটা বোঝার জন্য যত সংখ্যক টেস্ট হওয়া দরকার সেটি হচ্ছে না। যে পরিমাণ কমিউনিটি জরিপ হওয়া দরকার সেটিও হচ্ছে না। ফলে এ পরীক্ষা দিয়ে করোনার গতি-প্রকৃতি, ধরন বলা সম্ভব নয়।

তার মতে, দেশে করোনা সংক্রমণের সাত মাস পার হতে চললেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে টেস্ট ও চিকিৎসা জনবান্ধব হয়নি। সেখানে নমুনা পরীক্ষা করাতে হলে নানা ধাপ পার হতে হচ্ছে। ফল পেতে ৩ থেকে ৭ দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দেশের তৃণমূল পর্যন্তর্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করানোর কথা বলা হলেও সরকার দীর্ঘদিনেও তা শুরু করতে পারেনি। সব মিলিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার এখনো সফলতা দেখাতে পারেনি। এ পরিস্থিতি শীতে সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হলে তা কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় বৈকি- যোগ করেন লেলিন চৌধুরী।

বর্তমানে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, তখন জনগণের মধ্যে করোনাভীতি কমাটাই স্বাভাবিক। করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যে কার্যক্রম চালু রাখা দরকার সেটা আমরা করছি না। করোনাকে আমরা তার নিজের মতো করেই চলতে দিচ্ছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেন নিজ থেকেই কমে যাবে।'

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112888 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1