সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বরাষ্ট্রে যাচ্ছে এনআইডি সেবা সবার হবে 'ইউনিক আইডি'

মন্ত্রিসভা বৈঠকে আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন
যাযাদি ডেস্ক
  ১৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনতে নতুন একটি আইন করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশে এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্ম নিবন্ধনের নম্বর, পাসপোর্টের নম্বর সব আলাদা। এতে একজনের অনেকগুলো নম্বর বহন করতে হচ্ছে। এ আইন পাস হলে দেশের সব নাগরিককে একটি করে স্বতন্ত্র 'আইডি নম্বর' দেওয়া হবে। এই আইডি নম্বরই হবে যে কোনো ব্যক্তির পরিচিতি নম্বর। জন্মের পরই এই আইডি নম্বর দেওয়া হবে।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে 'জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩'-এর খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, 'আমাদের উদ্দেশ্য হলো সকল নাগরিকের ইউনিক নম্বর থাকা দরকার। সবার ইউনিক নম্বর থাকবে। সেটি দিয়েই তাকে চিহ্নিত করা হবে। জন্মের পর থেকে এই নম্বর পাওয়ার অধিকারী হবে। নতুন নিবন্ধক এটি করবেন। সফটওয়্যার বা যন্ত্রপাতি যা লাগবে সেগুলো সরকার দেবে। নিবন্ধক তার সুবিধামতো অফিস স্থাপন করবেন।'

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, নতুন আইন পাস হলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে পরিচালিত হবে। যে কোনো নাগরিক জন্মের পর পরই নাগরিক সনদ বা নম্বর পাবে,

এটি অপরিবর্তনীয় হবে।

এদিকে, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসার পর নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ করবে বলে জানান তিনি। এখন যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, তাদের এনআইডি নম্বর অপরিবর্তিত থাকবে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

তিনি বলেন, 'এনআইডি নম্বর কন্টিনিউ হবে। যাদের এনআইডি নম্বর হয়নি তারা এখন থেকে নতুন নম্বর পাবে। যখন এই নম্বর পেয়ে গেল, আর কোনো নম্বর লাগবে না।'

মাহবুব হোসেন জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসার পর একজন নিবন্ধক এসব কাজ করবেন। তার আওতাধীন জনবল কাঠামো থাকবে। বিধি দিয়ে এসব নির্ধারণ করা হবে।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির সময় জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করা হয়। তখন থেকে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে আসছে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন।

২০১০ সালে ইসির অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও পায়। পরে স্মার্ট এনআইডিও ইসির ব্যবস্থাপনায়ই হয়। এখন নানা ধরনের সেবা পেতে নাগরিকদের এনআইডি প্রয়োজন হয়।

২০২১ সালের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এক সপ্তাহ পর ২৪ মে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ উক্ত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এনআইডি নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

ওই চিঠিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য 'রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬'-এর রুল ১০ অনুসরণে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে 'জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০'-এ 'নির্বাচন কমিশন'র পরিবর্তে 'সরকার' শব্দ অন্তর্ভুক্তকরণসহ প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এ ছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।

একই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ জুন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিজেদের কাছে রাখার বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় ইসি। চিঠিতে কমিশন জানায়, এনআইডির কাজ অন্য বিভাগে গেলে ভোটার তালিকা করা ও তা হালনাগাদ এবং নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমস্যা হবে। সরকারের এ পদক্ষেপকে তখন 'সংবিধানবিরোধী' বলেও আখ্যা দেয় কমিশন।

ইসির সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো পত্রের আলোকে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমতাবস্থায়, নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

নির্বাচন কমিশন ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করে। ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রমও পরিচালিত হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনেই এনআইডি নিবন্ধন অণুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।

এনআইডি সেবা কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে শুরু থেকেই ইসি বলছিল, যে কাজটি কমিশন করছে সেটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হলে নতুন জনবল ও অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। এতে খরচ হবে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়ে কমিশন নাগরিকদের ৩২ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ফলে এনআইডি সেবা কার্যক্রম কমিশনের হাতে থাকাই যুক্তিযুক্ত।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গত বছরের ২৯ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কমিশনের হাতেই থাকা উচিত। তখন এক ব্রিফিংয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসির শুধু অঙ্গহানিই হবে না, এর মাধ্যমে কমিশনের কফিনে শেষ পেরেক যুক্ত হবে।

তবে এনআইডি সেবার দায়িত্ব থেকে নির্বাচন কমিশনকে বাদ দেওয়ার চিন্তা আগে থেকেই ছিল সরকারের। এ ক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি ছিল, শুধু ভোটার নয়, এনআইডি হবে দেশের সব নাগরিকের জন্য। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাসহ আরও অনেক কাজে এনআইডির ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার।

ইসি থেকে স্বরাষ্ট্রে এনআইডি সেবা হস্তান্তর নিয়ে দেশের একশ্রেণির মানুষের আশঙ্কা, যেহেতু ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এনআইডি ব্যবহার করা হয়, ফলে ভবিষ্যতে এটিকে কেন্দ্র করে ভোটের ফলাফল প্রভাবিত হলেও হতে পারে।

শরীয়তপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়

এদিকে, মন্ত্রিসভা বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শরীয়তপুর আইন এবং ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শরীয়তপুরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রস্তাব ছিল। সেটি নীতিগত অনুমোদন ছিল। নামকরণ করা হয়েছিল শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আরও বলেন, 'আজকে আইনের খসড়া বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। বিস্তারিত আলোচনার পর এটি অনুমোদন হয়েছে। তবে এটি শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটির নাম হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শরীয়তপুর। এ নামে এটি আজকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। নতুন দুটি নিয়ে দেশে অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এ ছাড়া শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে