সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

একযোগে ৫ ধরনের জ্বরের হানা

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারে যে সংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু চিকিৎসা নিতে আসছে তার অর্ধেকের বেশি জ্বরের রোগী। এদের একটি অংশ ডেঙ্গুতে এবং বাকিরা সিজনাল ফ্লু, ভাইরাল ফিভার, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত। এর বাইরে পাহাড়ি বেশকিছু এলাকায় ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। অনেকে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সুস্থ হলেও জ্বরের কারণে শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় অসংখ্য রোগী প্রতিদিন বিভিন্ন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছে।

দেশে একযোগে ৫ ধরনের জ্বরের হানা দেওয়ার ঘটনাকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন। তারা অনেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জ্বরের রোগীদের একটি বড় অংশের শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ থাকছে না। এতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। যদি এভাবেই রোগী বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক এবং বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার আহমেদুল কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক হারে জ্বরের রোগী চিকিৎসকদের কাছে আসছে। পরীক্ষায় কিছু মানুষের ডেঙ্গু, আবার কিছু মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা, সিজনাল ফ্লু বা ভাইরাল ফিভার ধরা পড়ছে। তবে হঠাৎ করেই এত সংখ্যক জ্বরের রোগী বেড়ে যাওয়াটা অবশ্যই আশঙ্কার বিষয়।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে চিকিৎসকদের ওপর অস্বাভাবিকভাবে চাপ বেড়েছে। যেখানে একজন চিকিৎসকের ১০ জন রোগী ম্যানেজ করার কথা, সেখানে তাদের এখন ২০ থেকে ৩০ জন রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ না কমানো গেলে এবং একসঙ্গে অন্যান্য জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা একই হারে বাড়তে থাকলে আগামীতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ মিডফোর্ট হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ-উন-নবী বলেন, তাদের আউটডোর রোগীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই জ্বর নিয়ে আসছেন, যাদের বেশিরভাগই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখন কিছুটা কমলেও অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের রোগী বেশি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের ডেঙ্গু ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুস্থতা এবং পানিবাহিত রোগ রয়েছে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগী নিউমোনিয়া, টাইফয়েডের মতো অন্যান্য জ্বরে আক্রান্ত।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটের কর্তব্যরত চিকিৎসক শারমিন ইসলাম বীথি বলেন, প্রতিদিন আসা রোগীদের ৭০ শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও টাইফয়েডের রোগীও রয়েছে। তবে শারীরিক অন্য কোনো জটিলতা না থাকলে সাধারণ টাইফয়েড রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।

রাজধানীর একাধিক প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ল্যাবের টেকনিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নমুনা পরীক্ষা করতে আসাদের মধ্যে তারা ডেঙ্গুর পাশাপাশি বেশকিছু টাইফয়েড-ইনফ্লুয়েঞ্জার রোগী পাচ্ছেন। তবে এদের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম। খুবই অল্প সংখ্যক রোগীর কোভিডও ধরা পড়ছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর এএসএম আলমগীর হোসেন বলেন, এখন শুধু ডেঙ্গুর নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জারও সিজন চলছে। বর্তমানে জ্বরের সঙ্গে যাদের সর্দি-কাশি আছে, এরকম প্রায় ৩০ শতাংশেরই ইনফ্লুয়েঞ্জা। জ্বরের সঙ্গে যাদের সর্দি-কাশি আছে, এরকম ৫ থেকে ১০ শতাংশ হলো কোভিড। আর জ্বরের সঙ্গে যাদের শরীর ব্যথা, চোখ ব্যথা আছে এরকম ১০-১২ শতাংশ ডেঙ্গু।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুর পাশাপাশি ভাইরাল ফিভারসহ অবশ্যই অন্যান্য জ্বরও আছে। সব ভাইরাস তো আর ডিটেক্ট করার জন্য মানুষ ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা করে না। কাজেই স্পেসিফিক করে না বলতে পারলেও ভাইরাল ফিভার, সিজনাল ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা- এসব তো এই সিজনে হয়ে থাকে। ডেঙ্গু হচ্ছে বলে ওগুলো যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা নয়। এসবের বাইরে কিছুদিন আগে চিকুনগুনিয়াও কিছু পাওয়া গিয়েছিল। এখনো হয়তো পরীক্ষা করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, বাসাবাড়িতে গণহারে জ্বর হচ্ছে এরকম খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এদের অনেকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে ভালো হয়ে যাচ্ছে। ফলে সব রোগীর ডাটাবেজ পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস থেকে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবে বিপুল সংখ্যক রোগীর হিসাব বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুলস্নাহ বলেন, জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়। এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ মাত্র। সাধারণভাবে বলা যায়, দেহে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমণে মানুষ জ্বরে ভোগে।

এই জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন, কোনো জ্বরই আসলে অবহেলা করা উচিত নয়। উপসর্গ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যদি জ্বরের সঙ্গে আরও অন্য কোনো উপসর্গ থাকে এবং এক সপ্তাহর পরও সেটি ভালো না হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে যারা শিশু, বয়স্ক এবং ক্রনিক কোনো রোগে আক্রান্ত তাদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত। তিনি জানান, কিছু জ্বর রয়েছে, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়েও দেখা দিতে পারে।

এবার ডেঙ্গু মারাত্মক হচ্ছে এবং সাধারণ ডেঙ্গুর কোনো লক্ষণও থাকছে না, তাই জ্বরের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক এ বি এম আব্দুলস্নাহ আরও বলেন, রোগীর দু-এক দিন জ্বর, অল্প গলাব্যথা, কাশি, হঠাৎ করে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, শক সিনড্রোম হচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে যায়, পালস পাওয়া যায় না, বস্নাড প্রেশার পাওয়া যায় না এবং অনেকে মারা যাচ্ছে। প্রায়ই ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মারা যাচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানান, কারও যদি জ্বর থাকে এবং জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা, মাথাব্যথা, ক্লান্তিভাব, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি ও নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তাহলে দেরি না করে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এসব লক্ষণ প্রাণঘাতী হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অ্যানোফিলিস নামে এক ধরনের স্ত্রী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে বা তার ব্যবহৃত সুঁচ ব্যবহারের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। প্রাথমিক উপসর্গগুলো সাধারণ জ্বর আক্রান্তের মতোই মৃদু হয় এবং ম্যালেরিয়া বলে শনাক্ত করাও কঠিন। তবে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারে। ৫ বছরের কম বয়সি শিশু, গর্ভবতী নারী, সফরে থাকা ব্যক্তি এবং এইচআইভি'তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে।

চিকিৎসকরা জানান, ঋতু পরিবর্তন কিংবা অন্য যে কোনো সময়ে হালকা জ্বর বা সর্দি-কাশিকে মানুষ মৌসুমি অসুখ বলে ধরে নিলেও অনেক সময় এটা ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ হতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা মূলত একটি ভাইরাল সংক্রমণ, যা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। বছরের যে কোনো সময়ই ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। তবে শীতকালে এর প্রকোপ বাড়ে।

সাধারণত সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, কথা বলা কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহারের মাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়ায়। এছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আছে, এমন কিছু স্পর্শ করার মাধ্যমেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়াতে পারে। এ ভাইরাস প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করে থাকে, যাকে বলা হয় মিউটেশন।

প্রাথমিকভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ হলে সাধারণ ঠান্ডা লাগার মতোই লক্ষণ দেখা দেয়। তবে সাধারণ ঠান্ডা লাগার সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের পার্থক্য হচ্ছে, এটি দ্রম্নত বেড়ে যায়। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণের লক্ষণগুলো হলো- হঠাৎ ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, শরীর দুর্বল ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, বমি-ভাব হওয়া কিংবা বমি হওয়া।

শরীরে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসক আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসনালি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) এবংর্ যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারবেন যে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না।

অন্যদিকে টাইফয়েডের অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে উচ্চমাত্রায় জ্বর। এছাড়া প্রচন্ড ক্লান্তি, মাথাব্যথা, বমি, পেট ব্যথা এবং আমাশয় ও ডায়রিয়াও থাকে। জ্বরের সঙ্গে এ ধরনের উপসর্গ অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়। তাই এ ধরনের উপসর্গ দেখলে দ্রম্নত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে