সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিদায় সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি

বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে

যাযাদি ডেস্ক
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী

বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, মানুষ শাসন বিভাগ, আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারাতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে ওই জাতিকে খারাপ সময়ের জন্য, খারাপ দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বৃহস্পতিবার বিচারিক কর্মজীবনের শেষ দিন বিদায় অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি বিচারালয়ে আইনজীবীদের বিভক্তি নিয়েও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জোর দিয়েছেন বিচারালয়ের স্বাধীনতা রক্ষায়। সেই সঙ্গে বিচারপতিদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত থেকে 'বিবেকের প্রতি অনুগত থাকার' পরামর্শ দিয়েছেন।

৬৭ বছর বয়স পূর্ণ করে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু সে সময় সুপ্রিম কোর্ট অবকাশে থাকবে বলে বৃহস্পতিবারই ছিল তার বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস। রেওয়াজ অনুসারে এ দিন তাকে আপিল বিভাগের এক নম্বর বিচার কক্ষে বিদায় সংবর্ধনা দেয় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।

বিদায়ী ভাষণে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, 'বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃদপিন্ড। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দক্ষতার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আর কোনো উপযুক্ত পরীক্ষা নেই। একটি জাতির জনগণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে; কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে সে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।'

আইনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বা প্রাধান্য কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'বিচার বিভাগ যদি আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ বা পিছপা হয় তাহলে রাষ্ট্র এবং নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।'

বিচারালয়ে আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদও আইনের শাসনের পথকে রুদ্ধ করে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করলে এবং বিচারালয়কে নিরাপদ দূরত্বে রাখলে বিচার বিভাগ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে মহান চিন্তা ও কল্যাণ চেতনাকে সন্নিবেশিত করে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তার ধারক ও বাহক হিসেবে, দেশের সব আইন ও সব আইনগত কার্যক্রম সাংবিধানিক চেতনার প্রতিফলন নিশ্চিত করার সুমহান জাতীয় দায়িত্ব আমাদের সবার।'

কনিষ্ঠ আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তোমরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো পরিশ্রমী ও শক্তিশালী হও, কিন্তু ভদ্রতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়-দয়ালু হও, কিন্তু দুর্বল নয়; সাহসী হও কিন্তু আদালতকে ধমকাবে না; চিন্তাশীল হও কিন্তু অলস হয়ো না; নম্র হও কিন্তু ভীরু হয়ো না; গর্বিত হও কিন্তু অহংকারী নয়; হাস্য রসিক হও কিন্তু মূর্খতা ছাড়া; সৎ থাকো, পরিশ্রম করো, একদিন দেখবে অনেক বড় আইনজীবী হয়ে গিয়েছ।'

সংবিধান প্রণেতারা 'স্বাধীন ও নিরপেক্ষ' বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন উলেস্নখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'সে স্বাধীনতা কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের এবং প্রতিটি নাগরিকের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একাত্তরের রক্ত বৃথা যাবে।'

শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। বিচারকদের রাজনৈতিকভাবে বয়ে যাওয়া হাওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে সংবিধান, আইন নিজেদের বিচারিক বিবেকের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগত থেকে বিচারকার্য সমাধান করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের অগাধ আস্থা স্থাপন করতে হবে এবং থাকতে হবে; নইলে জনগণের অধিকার রক্ষা হবে না এবং স্বাধীনতাও বিপন্ন হবে।'

প্রতিটি আইনে 'মানবিকতার স্পর্শ' থাকতে হবে মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয় আর ধনী ব্যক্তি যদি আইনকে পিষে দেয়, তাহলে রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না।'

অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র দায়িত্ব হলো সংবিধানের প্রতিটি অক্ষরের প্রতি অনুগত থাকা এবং সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া।'

বিচার বিভাগকে পরিবর্তন ও সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার আকাঙ্ক্ষা সবসময় কাজ করেছে জানিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'হয়ত আমি নাড়া দিতে পেরেছি মাত্র। আমার পদক্ষেপগুলো তাদের সমাধানের পথের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু সম্পূর্ণ সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার নিয়ামক শক্তিগুলোর একই মন-মানসিকতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আর সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং পদক্ষেপ।'

বাংলাদেশকে বসবাসের জন্য 'আরও ভালো জায়গা করার লক্ষ্যে', জনগণ যাতে স্বল্প খরচে স্বল্প সময়ে 'ন্যায়বিচার' পায় তার জন্য বিচারকদের উদ্ধুদ্ধ করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বলেও জানান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, 'চেষ্টা করেছি, বিচারপ্রার্থী অভাগা মানুষগুলো আদালত প্রাঙ্গণে এসে একটু স্বস্তিতে বসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে।'

বিচারক এবং আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আমার বিচার বিভাগ তার কাছেই হস্তান্তর করতে যাচ্ছি যিনি এই বিভাগকে আরও গতিশীল করার জন্য ক্ষমতাবান এবং মনোযোগী হবেন।'

বিদায়ী বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার কর্মকালীন সম্মানিত বিচারক, বিজ্ঞ আইনজীবী, আইন, বিচার এবং সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ, জনপ্রশাসন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ এবং সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির প্রত্যেক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এবং সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা যে সহায়তা দিয়েছেন তা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সারা জীবন মনে রাখব।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শপথ বাক্য পাঠ করান।

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ১৯৫৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা শেষে ১৯৮১ সালের ২১ আগস্ট জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট এবং ১৯৯৯ সালের ২৭ মে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।

হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খুলনা সিটি করপোরেশন, কুষ্টিয়া পৌরসভা, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির আইন উপদেষ্টা ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলও।

২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগে এবং ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ আপিল বিভাগে নিয়োগ পান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এছাড়া তিনি ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার বড় ভাই বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ১৯৮০ সালের ২৩ এপ্রিল মুন্সেফ হিসেবে বিচার বিভাগের নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে জেলা ও দায়রা জজ হন। ২০০৯ সালের ৩০ জুন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং দুই বছর পর স্থায়ী নিয়োগ পান। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর তিনি আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। ২০২১ সালে ১৫ জুলাই অবসরে যান তিনি। এরপর বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী আইন কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে