সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে ঠিক করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় 'হামুন'র নাম

আলতাব হোসেন
  ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ঘূর্ণিঝড় এক আতঙ্কের নাম। আজ বুধবার উপকূলে আঘাত হানতে পারে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হামুন। নামটি শুনতে সুন্দর ও শ্রম্নতিমধুর হলেও ঘূর্ণিঝড়টি প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠতে পারে। তছনছ করে দিতে পারে উপকূলের সবকিছু। মুহূর্তেই ধ্বংস করে চালাতে পারে তান্ডবলীলা। তাই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয় সহজ, যাতে সবাই মনে রাখতে পারে।

অথচ একটা সময় ছিল যখন ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম থাকত না। দেশ-বিদেশে ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো নাম নেই। ঝড়ের নাম রাখার একটি প্রচলন শুরু হয় একপর্যায়ে। কারণ, নামবিহীন থাকলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের

\হশক্তি, ধরন সম্পর্কে তথ্য দ্রম্নত জানা যায় না। এর আঘাত হানার সময় বা তারিখ বের করে পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করতে হয় আবহাওয়াবিদদের। এতে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। এরপর আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডবিস্নউএমও) ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ডবিস্নউএমও সেজন্য পাঁচটি বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার (আরএসএমসি) সঙ্গে সমন্বয় করে ২০০৪ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে।

উত্তর ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করে এই অঞ্চলের ১৩টি দেশ। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড মেটেরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন প্যানেল সদস্য দেশগুলো ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এই নামগুলো গ্রহণ করে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।

তালিকা অনুযায়ী চলমান ঘূর্ণিঝড়েরর নাম হচ্ছে- হামুন। এই নামটি দিয়েছে ইরান। যার অর্থ হচ্ছে সমতল ভূমি বা পৃথিবী। এর পরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম হবে মিধিলি। যার নাম দিয়েছে মালদ্বীপ। এর পরের ঘূর্ণিঝড়েরর নাম হবে মিগজাউম। যার নাম দিয়েছে মিয়ানমার ও তালিকার সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড়েরর নাম হবে রিমাল। যার নাম দিয়েছে ওমান। এরপর নতুন করে সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে আবার নতুন নাম সংগ্রহ করবে ওয়ার্ল্ড মেটোরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডবিস্নউএমও)।

গত কয়েক শতাব্দী ধরে আটলান্টিক ঝড়ের নাম দেওয়া হয়ে আসছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এরপরে আবহাওয়াবিদরা মিলে মেয়েদের নামে ঝড়গুলোর নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া সেবা অফিস আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়েদের নামে ঝড়ের নামকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বছরের প্রথম ঝড়ের নাম রাখা হতো অ আদ্যক্ষর দিয়ে, দ্বিতীয় ঝড়ের নাম রাখা হতো ই আদ্যক্ষর দিয়ে; এভাবে চলতে থাকত। আবার জোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর (ধরা যাক, ২০২২ সালের ৩য় ঝড়) নাম রাখা হতো ছেলেদের নামে আর বিজোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর নাম রাখা হতো মেয়েদের নামে। এ নিয়ে ৬০ এবং ৭০-এর দশকে নারীদের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে ১৯৭৮ সালে ছেলেদের নামেও ঝড়ের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে বেশিরভাগই নারীর নামে। যেমন- রিটা, ক্যাটরিনা, নার্গিস, স্যান্ডি, রেশমি, বিজলি, অগ্নি, নিশা, গিরি, হেলেন, চপলা, অক্ষি, লুবান, তিতলি, বাজু, নাদা, মেঘ, প্রিয়া, নিলুফার, মাদি, শ্যামা, হিকা, সোবা ইত্যাদি।

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, একটা সময় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হতো অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের ওপর ভিত্তি করে। তখন বলা হতো ৬ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ও ৬২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ঝড়টি এখন বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। ঘূর্ণিঝড়ের এ বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য লাগত। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে মানুষ বা নৌযানগুলো সতর্ক হতে পারত না। একই সময়ে একাধিক ঝড় সৃষ্টি হলে, বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য সহজে মনে রাখা এবং পার্থক্য করা যায় এমন নাম রাখা হয়। ভয়াবহতার দিক থেকে বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে বৈশিষ্ট্য প্রায় একই। তবে স্থানীয়ভাবে ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন- সাইক্লোন বলা হয় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোকে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় টাইফুন। আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকার ঘূর্ণিঝড়গুলোকে বলা হয় হারিকেন। সাধারণত একটু শক্তিশালী ঝড়কেই (বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৭৪ মাইলের বেশি) হারিকেন নামে ডাকা হয়, যার নামকরণ করা হয়েছে ওই অঞ্চলের আদি অধিবাসী মায়াদের ঝড়বৃষ্টির দেবতা হুরাকানের নামে। মহাপরাক্রমশালী ঘূর্ণিঝড়ের নাম ফণী। এর অর্থ সাপ বা ফণা তুলতে পারে এমন ভয়ঙ্কর প্রাণী। ফণী নামটি ছিল বাংলাদেশের দেওয়া।

আবহাওয়াবিদ আব্দুর রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় নামবিহীন থাকলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, ধরন সম্পর্কে দ্রম্নত তথ্য জানা যায় না। এর আঘাত হানার সময় বা তারিখ বের করে পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করতে হয় আবহাওয়াবিদদের। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মও মানা হয়। যেমন- এমন নামই দেওয়া হয় যা ছোট হবে এবং সাধারণ মানুষ সহজে উচ্চারণ করতে পারে। যে দেশ নাম রাখবে তার সঙ্গে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হয় ওই শব্দ যেন কাউকে আঘাত না করে। কোনো রকম ব্যঙ্গ, বিদ্রম্নপ বা আতঙ্ক ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এমন নামও রাখা যায় না। কোনো ধর্মীয় সম্পর্ক বা ব্যক্তি নামও ব্যবহার করা হয় না। যেমন 'আমপান'-এর নামকরণ করেছিল থাইল্যান্ড। আবার 'ফণী' ঝড়ের নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ। 'বুলবুল' নাম ছিল পাকিস্তানের দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০১৩ সালে একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছিল 'মহাসেন'। নামটি প্রস্তাব করেছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু সেখানকার সাবেক একজন রাজার নাম ছিল 'মহাসেন', যিনি ওই দ্বীপে সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলেন। ফলে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যমে সেটিকে নামহীন ঝড় বলে বর্ণনা করা হয়। পরবর্তীতে রেকর্ডপত্রে ঝড়টির নতুন নাম নির্ধারণ করা হয় 'ভিয়ারু'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে