রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
শুধু আবেদনেই চলছে কার্যক্রম

অনিবন্ধিত চিকিৎসাকেন্দ্রের ছড়াছড়ি!

সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অনিবন্ধিত চিকিৎসাকেন্দ্রের ছড়াছড়ি!

রাজধানীতে ৬ বছরের শিশু আয়ানকে অতিরিক্ত এনেসথেসিয়া দিয়ে খৎনা করাতে গিয়ে মৃতু্যর কোলে ঠেলে দেওয়া বাড্ডার সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও এ প্রতিষ্ঠানটির কোনো নিবন্ধন নেই। তারা নিবন্ধনের জন্য শুধু আবেদন দিয়েই চিকিৎসা-সেবা চালু করেছিল। প্রশাসনের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন ধরে এ অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও শিশু আয়ানের মৃতু্যর ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ 'টু' শব্দটা করেনি।

স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু এই একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, ঢাকাসহ সারাদেশে আবেদনসর্বস্ব ও অননুমোদিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েক হাজার। যারা বছরের পর বছর ধরে ওই আবেদনের উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এজন্য তাদেরকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দুর্নীতিবাজ চক্রকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির এ বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ লোকবল সংকটের দোহাই দিয়ে তা এড়িয়ে যাচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এর পরপরই হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিবন্ধনের জন্য আবেদনের হিড়িক পড়েছে। বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিবন্ধন নবায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের অন্যান্য সময়ে সপ্তাহে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০টি আবেদন জমা পড়ত। তবে এখন দৈনিক আবেদন জমা পড়ার সংখ্যা ৩শ' ছাড়িয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তের পরপরই নতুন নিবন্ধন বা নিবন্ধন নবায়নের আবেদনের সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে যাওয়াটা ভালো লক্ষণ। নিবন্ধন না থাকা সব প্রতিষ্ঠানই অবৈধ। অবৈধ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা হতে দেওয়া যায় না। এ অবস্থায় সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এর ফলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। তবে গুণগত মান তদারকি না করে শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিংবা নিবন্ধনের আবেদনকৃত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দিলে চিকিৎসা ব্যবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশ খোলামেলাভাবে চিকিৎসাবাণিজ্যে নেমে পড়বে।

অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, পাঁচ ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে। এর মধ্যে আছে- হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বস্নাড ব্যাংক, ডেন্টাল ক্লিনিক ও মেডিকেল চেক-আপ সেন্টার। মেডিকেল চেক-আপ সেন্টার বিদেশগামী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার। প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষকে অনলাইনে আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বস্নাড ব্যাংক, ডেন্টাল ক্লিনিক ও মেডিকেল চেক-আপ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের জন্য আলাদা শর্ত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠানের আবেদন অনুমোদনের অপেক্ষায় (পেন্ডিং) ছিল। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের আবেদনে ত্রম্নটি ছিল। অন্যদিকে নতুন দেড় সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্র ঠিকঠাক থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরিদর্শন হয়নি বলে তারা নিবন্ধন পায়নি। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হবে, তাদের খুব শিগগির নিবন্ধন দেওয়া হবে। আমরা এ ব্যাপারেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছি।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিবন্ধনের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে, এর বেশিরভাগই চিকিৎসাসেবা চালু করে দিয়েছে। অথচ এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে নিবন্ধিত চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স, ডিগ্রিধারী টেকনোলজিস্ট আছে কি না, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তা যাচাই করা হয়নি। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হচ্ছে প্রায় সব ধরনের রোগী। ভাড়া করে আনা হচ্ছে চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালানো হচ্ছে রমরমা বাণিজ্য। বেশির ভাগের নিয়মমাফিক অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এমনকি বৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশের অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার রোগী সুষ্ঠু চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা দেখেও না দেখার ভান করছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদনের জন্য মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, আয়কর প্রত্যয়নপত্র, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিকস পারমিট, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্রসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল থাকতে হয়।

১০ শয্যার একটি ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে হলে ওই ক্লিনিকে কমপক্ষে তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, ছয়জন নার্স ও দুইজন ক্লিনার থাকতে হয়। প্রত্যেকটি বেডের জন্য থাকতে হয় কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা। অপারেশন থিয়েটার হতে হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেইসঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি যা থাকতে হবে তার একটি তালিকাও দেওয়া আছে। তবে আউটডোর, জরুরি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটার সব ক্লিনিকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাসপাতালের ধরন অনুযায়ী শর্ত নির্ধারণ করা হয়।

হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনলাইনে আবেদন করতে হয় চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওই চিকিৎসাকেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য সিভিল সার্জনকে চিঠি দেয়। সিভিল সার্জন সেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেন। এরপর হাসপাতাল-ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। তা দেখে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমতি দেবেন সিভিল সার্জন। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেদন দেওয়ার পর বাকি ধাপগুলো পার হওয়ার আগেই চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করা হচ্ছে।

এদিকে দায়িত্ব হাতে নিয়েই নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন অবৈধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধের যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এর আগেও বেশ কয়েক দফা ঢাকঢোল পিটিয়ে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু কোনোবারই তেমন সফলতা আসেনি। এমনকি অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশ করতে পারেনি। বরং অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করায় বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত এবং নিবন্ধনের আবেদন সর্বস্ব অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নির্বিঘ্নে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে কয়েকদিনের অভিযানে অনিবন্ধিত ও আবেদনসর্বস্ব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কার্যক্রম থামানো যাবে না। থানা থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। বন্ধ করে দেওয়া অবৈধ প্রতিষ্ঠান আবার চালু করা হয়েছে কিনা তা মনিটর করতে হবে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্র ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো চলছে কিনা তারও নিয়মিত তদারকি জরুরি।

এদিকে, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে মানুষ মারার 'আখড়া' আখ্যায়িত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন কার্যালয় ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকের কাছ থেকে। অধিকাংশ সিভিল সার্জন বসে বসে টোল কালেক্ট করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া এত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শনের মতো জনবল স্বাস্থ্য প্রশাসনে না থাকার সুযোগ নেন তারা।

এদিকে, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এমনকি এর কোনো তালিকা তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অপকটে স্বীকার করেছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. মনিরুল আহসান বলেন, 'অবৈধ ক্লিনিক নিয়ে আমরা কোনো জরিপ করিনি। তবে আমরা গত দেড়-দুই বছরে আটশ'র মতো অবৈধ ক্লিনিক পেয়েছি। তাদের অধিকাংশই আবেদন করে বা ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ক্লিনিক চালাচ্ছিল। এবার হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে। তাই আমরা একটা জরিপ করব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে