শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা

হাওড়াঞ্চলে কালবৈশাখীর তান্ডব

যাযাদি ডেস্ক
  ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ঝড়ে অটোরিকশার ওপর আছড়ে পড়া গাছ -সংগৃহীত

সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ কালবৈশাখী এবং শিলাবৃষ্টিতে হাওড় অঞ্চলের উঠতি বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি এসব অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু গাছপালা ও ঘরবাড়ি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একেকটি শিলাখন্ডের ওজন ছিল ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। রোববার রাতে আঘাত হানা কালবোশেখীর সঙ্গে ব্যাপক শিলাঝড় শুরু হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিলার আঘাত এবং মানুষের হুড়োহুড়িতে তিন জেলায় অন্তত দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

সিলেট অফিস জানায়, সিলেটে হঠাৎ করেই স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় ১০ মিনিটের মতো চলা শিলাঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেটবাসীরা অনেকেই সামাজিক গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, নিকট অতীতে তারা এরকম বড় বড় শিলা দেখেননি। এক খন্ড শিলার ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম বলেও তারা দাবি করেছেন।

সিলেট নগরী ও শহরতলির আশপাশের টিনের তৈরি ঘরের ব্যাপক ক্ষতি করেছে শিলাবৃষ্টি। শিলার আঘাতে ভেঙেছে কয়েকশ' গাড়ির কাঁচ। আহত হয়েছেন ৬৩ জন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সিলেট সদর উপজেলায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ টিনের তৈরি বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের সবক'টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়ন ও ৪নং খাদিমপাড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়ন দু'টি ভৌগোলিক অবস্থা পাশাপাশি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বাকি ইউনিয়নগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এই দু'টি ইউনিয়নের চেয়ে কিছুটা কম।

খাদিমনগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. দিলোয়ার হোসেন বলেন, 'আমার ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টিনের ঘরের প্রায় ৮০ ভাগ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'

সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছরীন আক্তার বলেন, 'শিলাবৃষ্টিতে উপজেলায় টিনের তৈরি ঘরবাড়ির ক্ষতি হওয়ার খবর পেয়েছি। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কি পরিমাণ সহায়তা করা হবে তা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়েছি। তালিকা হাতে পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে সরকারি সহায়তা বিতরণ করা হবে।'

গোলাপগঞ্জে আহত ৪০

শিলাখন্ডের আঘাতে সিলেটের গোলাপগঞ্জে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে বেশির ভাগই ঘরের টিনের চালা ফুটো হয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা শহরে পাঠানো হয়েছে।

সোমবার দুপুরে গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদর্শন সেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রিকশাচালক বিলস্নাল আহমদের বোন রুমি বেগম বলেন, কালবৈশাখীর সাজ দেখে দ্রম্নত রিকশা নিয়ে বাড়িতে আসেন বিলস্নাল। ঘরে ফেরার পর শুরু হয় ঝড়-তুফান। এ সময় টিনের চালা ফুটো হয়ে একটি বড় শিলাখন্ড তার চোখের ওপর পড়ে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। আহতাবস্থায় তাকে প্রথমে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে সিলেট এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

শিলাখন্ডের আঘাতে মাথা ফেটে আহত গোলাপগঞ্জের বারকোট এলাকার বাসিন্দা সিরাজ মিয়া বলেন, 'ঝড়ের সময় ঘরের ভেতরেই ছিলাম। হঠাৎ একটা বড় শিলাখন্ড মাথায় পড়লে মাথা ফেটে যায়। হাসপাতালে এসে মাথায় দু'টি সেলাই দেওয়া লেগেছে।'

গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদর্শন সেন বলেন, 'কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টির পর অন্তত ৩০-৪০ জন আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। প্রত্যেকেই শিলাখন্ড পড়ে আহত হন। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগকে মাথায় সেলাই দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে উন্নত চিকৎসার জন্য সিলেটে পাঠানো হয়েছে।'

'জীবনেও এমন শিলাবৃষ্টি দেখিনি'

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের কায়স্থগ্রামের বাসিন্দা ৮০ বছর বয়সি আব্দুল আজিজ বলেন, 'বয়স অনেক হলো, এই রকম শিলাবৃষ্টি কখনো দেখিনি, একেকটা শিলার ওজন অনুমান করেছি ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম হবে। প্রচন্ড শব্দে মনে হয়েছিল, ঘরের টিন ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে।'

রোববার পৌনে ১টার দিয়ে হরিগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যায় কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ির টিন ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা অলিউর রহমান অলি বলেন, 'ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি কমার পর হাতে নিয়ে অনুমান করি ওজন হবে আধা কেজি।'

নবীগঞ্জ পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সায়েদ আহমদ বলেন, 'এমন ভয়াবহ তান্ডব আগে দেখিনি। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি সত্যিই মুহূর্তটা ভয়ংকর ছিল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আতঙ্কে ছিলাম। আমার নিজের বাসা ও আশপাশের অনেক বাসাবাড়িতে গাছপালা ভেঙে পড়েছে।'

সুনামগঞ্জে আহত শতাধিক

রোববার রাতে কালবৈশাখীর সঙ্গে ব্যাপক শিলাবৃষ্টির ফলে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং হাওড়ের বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে গাছ পড়ে, বসতঘর ধসে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। এরপর ঝড় থামলেও রাতভর থেকে থেকে বৃষ্টি হয়। ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমপাগলা ইউনিয়নের পাগলাবাজার, রায়পুর কান্দিগাঁও, মির্জাপুর, নবীনগর গ্রামের ঘরবাড়ি বেশি ক্ষতিক্ষস্ত হয়েছে।

শান্তিগঞ্জের বাসিন্দা শিক্ষক ইয়াকুব শাহরিয়ার জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রচন্ড ঝড় ও ব্যাপক শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। তিনি তখন উপজেলার পাগলাবাজারে ছিলেন। ঝড়ে বাজারের অনেক দোকানপাট তছনছ হয়ে যায়। আশপাশের গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপজেলার হাওড় এলাকাতেও শিলাবৃষ্টি হয়েছে।

ঝড়ে বসতঘর ধসে অন্তত শতাধিক মানুষ আঘাত পেয়েছেন। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে কেউই গুরুতর আহত হননি। শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ জানান, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় অনেকেরই থাকার জায়গা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করা হচ্ছে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, 'প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সব এলাকায় খোঁজ নিচ্ছি। ঝড়ের উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৫০০ শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট আংশিক ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তালিকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঝড়ের সময় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।'

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কালীবাড়ি এলাকায় ঝড়ে একটি অটোরিকশার ওপর গাছ ভেঙে পড়ে। এতে ওই অটোরিকশার তিনজন যাত্রী আহত হন। কালীবাড়ি এলাকায় বাসিন্দা রাজু আহমেদ জানান, গাছ ভেঙে অটোরিকশায় পড়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে তারা হাসপাতালে পাঠান। ঝড় থামার পর এলাকার লোকজন সড়ক থেকে গাছটি সরিয়ে নেন।

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসক নিরুপম রায় চৌধুরী বলেন, 'ঝড়ের সময় আঘাত পেয়ে সাদ্দাম হোসেন নামের একজন হাসপাতালে এসেছিলেন। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।'

ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা হাসান আহমদ জানান, তাদের উপজেলাতেও ব্যাপক ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ে সড়কের ওপর গাছ পড়ে। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছিল। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে গাছ সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, 'হাওরে ধানের অবস্থা ভালো। আমরা সব হাওড়েই খোঁজ রাখছি। রাতে হাওড় এলাকায় শিলাবৃষ্টি কম হয়েছে। এ কারণে ফসলের ক্ষতি কম হয়েছে।'

সোমবার সকালে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে